সুবল সরদার
ত্রাণ (Relief) বিলি এখন হুজুগ। ত্রাণ পেলে সুন্দরবন (Sunderban) নাকি ধন্য? তাই শহুরে বাবুরা দলে দলে সুন্দরবনে ছুটে যাচ্ছেন। এখন মিশন সুন্দরবন। ইয়াসে নদী বাঁধ ভেঙেছে। গ্ৰামে জল ঢুকেছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। খাবারের জন্যে মানুষের হাহাকার। বেঁচে থাকা ভীষণ কঠিন। এরই মধ্যে ত্রাণ বিলি নিয়ে প্রতিযোগিতা, হুড়োহুড়ি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত মানুষের পাশে কে না দাঁড়াতে চায়?
কিন্তু প্রতিবছর নদী বাঁধ ভাঙে কেন? মানুষের কেন এই হাহাকার? নদী বাঁধ ভাঙা আর ত্রাণ বিলির মধ্যে কোনও যোগসূত্র নেই? নদী বাঁধ ভাঙে বলে তো ত্রাণ আসে । তাই ত্রাণ নিয়ে এতো প্রচার, এতো ব্যবসা। কর্পোরেট ধাঁচে ত্রাণ বিলি করে তাঁরা ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। আবার ত্রাণের পিছনে রয়েছে ভোটের অঙ্কও।
ক্ষুধার্ত মানুষ রুটি, গুড় খেয়ে বেঁচে থাকতে চায় । ত্রিপল পেলে ছাউনি করে রাত কাটাতে পারে । তাদের অতশত বোঝার কি দরকার। তারা শুধু জানে, তাদের কোনও মুক্তির পথ নেই। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দিয়ে মহত্ব প্রকাশের কি ইচ্ছা ! এ ত্রাণে কেউ কখনও পুণ্যির আশা করে?
প্রতিবছর সুন্দরবন উন্নয়নের সরকারি টাকাগুলো যায় কোথায়? দেশবিদেশ থেকে যে কোটি কোটি টাকা আসে, সেই টাকায় কী হয়? শুধু লুটপাট ,স্বজনপোষণ? তাই উন্নয়নের বাঁধ কাঁদে শুধু নদীর পাড়ে বসে। সবাই জানে নদী বাঁধ ভাঙে বলে কাটমানির বখরা হয়। প্রতি বছর বর্ষার আগে নমো নমো করে নদী বাঁধে মাটি ফেলে। আর হেলিকপ্টার থেকে সুন্দরী গাছের দানা ছড়ায়। তারপর সব দায়িত্ব শেষ।
নোনা জলের টানে আমরা বারবার সেখানে ছুটে যাই। কিন্ত আমরা কখনও সুন্দরবনকে ভালোবেসেছি? তাদের সত্যিকারের উন্নয়ন নিয়ে কখনও ভেবেছি? আমরা ভাবি, সুন্দরবন মানে শুধু দারিদ্র্য। তাদের জীবন শুধুই ত্রাণ নির্ভর। তারা কেবল অন্যের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে থাকে।
কিন্ত কখনও ভেবেছি কি, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাদের কঠোর জীবনযুদ্ধের কথা। বাঘ, কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে বেঁচে থাকে তারা ? ফি বছর প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আর তার মধ্যে ঝড়-তুফানের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই। সাগরের অসীম নোনা জল, বিস্তীর্ণ বাদাবনে তারা খুঁজে পায় জীবনের রসদ।
আসলে ম্যান-মেড (Man-made) সমস্যা মানুষ কখনও সমাধান করতে পারে? যদি মানুষের কোনওদিন মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটে, যদি কোনওদিন রাজনীতির বেড়াজাল থেকে বের হতে পারে, সেদিন সুন্দরী গাছের গোঁজে তাদের পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরবে না। আত্মসম্মান বিলিয়ে দিয়ে তারা ত্রাণ নিতে অপারগ হবে। সেদিন সুন্দরবন আরো বেশি অকৃত্রিম ও সুন্দর হবে।