তরুণ গোস্বামী, সাংবাদিক
আজ একত্রিশ মে। এই দিনে 1893 সালে স্বামীজী বোম্বে থেকে জাপান ঘুরে আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন। বয়েস সবে তিরিশ ছুঁয়েছে। ধর্ম সভা কবে শুরু হবে জানতেন না। শিকাগো জায়গাটা কেমন, কতটা ঠান্ডা, তখন তো গুগল নেই ছেলেটাকে কেউ বলে দেয় নি। অনেক ভারতীয় রাজা তাঁর বন্ধু, শিষ্য ছিলেন কেউ একটা পরিচয় পত্র দিলেন না। মূলত পুলিশের ভয় এবং ইংরেজদের চটাবেন না বলে। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন তিরিশ বছরের একটি ছেলে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিলো। উদ্দেশ্য একটাই ভারতের সমন্বয়ের বাণী পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া।
আমার লেখার একটি উদ্দেশ্য আছে। এক দল উগ্র হিন্দুত্ববাদী আছে, যারা বলতে শুরু করেছে রামকৃষ্ণ মিশন মুসলমান তোষণ করে, হিন্দু ধর্মের কথা বলে না। আর, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে বাবাজিরা ঘরে বসে থাকেন, এগিয়ে আসেন না। অনেকেই বলবেন পাগলে কি না বলে। এরা কেউ পাগল নয়। এই কাজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হচ্ছে। যারা করছে তারা তরুণ তরুণী। তাই ভাবলাম প্রতিবাদ করা দরকার।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে Bertrand Russell প্রতিবাদ করে লিখেছিলেন, “I thought it was my duty to protest, however futile that protest might be.”
সিস্টার নিবেদিতা স্বামীজীর দর্শন চিন্তা নিয়ে বলেছিলেন, “When he began to speak it was the religious ideas of the Hindus. When he ended Hinduism had been created.”
স্বামীজী 11 সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্ব ধর্ম মহাসভার প্রথম অধিবেশনে যে বক্তৃতা দেন তার দুটি লাইন লিখছি, “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. I am proud to belong to a religion in whose sacred language the Sanskrit the world exclusion is untranslatable.”
স্বামীজী 1898 সালে সরফরাজ হোসাইনকে চিঠিতে লেখেন, “I see in my mind’s eyes future India rising , glorious and invincible , a Vedantic brain with an Islamic body is the only hope for India.”
রামকৃষ্ণ মিশন ভারতবর্ষের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে দুর্গা পুজো, কালী পুজো হয়, chirstmas eve পালিত হয়, বুদ্ধ জয়ন্তী পালিত হয় এবং হযরত মোহাম্মদের পবিত্র জীবন নিয়ে আলোচনা হয়। স্বামীজীর 1900 সালে সানফ্রান্সিসকোতে দেওয়া হযরত মোহাম্মদের জীবন ও বাণীর ওপর বক্তৃতাটি পড়তে অনুরোধ জানাই।
স্বামীজী ভারতবর্ষে ধর্মের ইতিহাসে একটি নতুন ভাব যোগ করেছিলেন। সেবা কাজের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির উন্নতি এবং সমাজের জাগরণ হলো ধর্মের মূল কথা। অধ্যাপক GS Ghurye তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Indian Sadhoos এ লিখছেন, “Social service of various kinds has now come to be realised as an important objective of ascetic and monastic life. Ananda ending names have gained favour among all sects of Indian sadhoos.”
সমাজ সেবক আধ্যাত্মিক এবং সাধু জীবনের অবশ্য কর্তব্য এবং নামের শেষে আনন্দ ব্যবহার করা স্বামীজীর অনুপ্রেরণার ফল। গত চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবা কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তার কিছু নমুনা দিচ্ছি। আমি ইদানিং কালে ঘটে পাঁচটি যাওয়া বড় সেবাকাজের উল্লেখ করবো।
1993 সালে মহারাষ্ট্রর লাতুরে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। মহারাষ্ট্র সরকার রামকৃষ্ণ মিশনকে পুনর্বাসনের দায়িত্ব দেন। স্বামী আত্মস্থানন্দজী এবং স্বামী মুক্তিনাথনন্দজীর নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়। যে সময়ে কাজ শেষ হবার কথা তার বহু আগেই কাজ শেষ হয় যায়।
1999 সালে Great Odisha cyclone বিধ্বস্ত ওড়িশা। রামকৃষ্ণ মিশন গ্রামের পুনর্বাসন করে। এখনো গেলে সেই গ্রামগুলো দেখা যায়।
2004 সালে সুনামি হয়। দক্ষিণ ভারতে মৎস্যজীবীদের গ্রামের পুনর্বাসন না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
2013 সালে কেদারনাথ বন্যা হয়। সাতদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিল। রাককৃষ্ণ মিশন ওই দুরূহ অঞ্চলে পুনর্বাসনের কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
রামকৃষ্ণ মিশন একমাত্র ধর্মীয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যার সন্ন্যাসীরা অন্ধ্র প্রদেশের পূর্ব গোদাবরী জেলাতে একটি সেতু নির্মাণ করেন। স্বামী শ্রীকিরানন্দজী, পূজনীয় চিত্ত মহারাজ এই কাজের মধ্যে ছিলেন। স্বামী স্মরণানন্দজী তখন সাধারণ সম্পাদক। উনি এবং তদানীন্তন অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু সেতুটির উদ্বোধন করেন। এই উপলক্ষ্যে গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মিশন কয়েকটি cyclone শেল্টার বানিয়েছিল, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষজন আশ্রয় নিতে পারে।
এবার ‘yaas’-এ পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে ঘটনার 24 ঘন্টার মধ্যে ত্রাণ শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে safe home শুরু হয়েছে।
স্বামীজী একটি কথা বারবার বলতেন, “ডাল কুত্তার খেয়োখেয়ি ছেড়ে সৎ সাহস, সৎ উপায়, সৎ বীর্য ধারণ করো। যদি জন্মেছ একটা দাগ রেখে যাও।”
আজ এই শুভ দিনে স্বামীজীর কাছে প্রার্থনা করি জানো এই জীবনে মানুষকে ভালোবেসে, সব সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে একটা দাগ রেখে যেতে পারি।