ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
ব্রিটিশ পুলিশের সবসময়ের জন্য নজর ছিল মঠ মিশনের কেন্দ্রবিন্দুতে এবং এর শাখাকেন্দ্রগুলিতে। নজর ছিল জয়রামবাটিতে মায়ের ভিটেতেও। মা সারদার ধারণা ছিল, নরেন বেঁচে থাকলে ‘কোম্পানি’ তাঁকে জেলে ভরে রাখত। প্রকৃতপক্ষে রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ, এই ত্রয়ী ছিলেন মহাবিপ্লবের প্রতীক। শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিরঞ্জিত দক্ষিণেশ্বরের মৃত্তিকা বিপ্লবীদের কাছে ছিল tremendous explosive material.
শ্রীরামকৃষ্ণ একবার নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, “মনে রাখিস ইংরেজরাই এদেশের সর্বনাশ করছে।” স্বামীজির কণ্ঠেও শোনা যায়, “তাঁরা আমাদের গলায় পা দিয়ে থেঁতলেছে, নিজেদের সুখের প্রয়োজনে আমাদের শেষ রক্তবিন্দু চুষে খেয়েছে, লুঠে নিয়ে গেছে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকা।” স্বামীজি বলেছিলেন, আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতমাতাই ভারতবাসীর একমাত্র উপাস্য দেবতা।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “শান্ত মোরা, ভদ্র অতি পোষ মানা এ প্রাণ/বোতাম আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।” এ বর্ণনা বাস্তব। কিন্তু এমন বাঙালিও জন্মান, যাঁরা ‘ব্যাঘ্রে-বৃষভে’ সমন্বয় ঘটান। তেমনি বাঙালি যুবক ছিলেন বিবেকানন্দ। শান্ত ছিলেন, ভদ্রও ছিলেন। কিন্তু নিদ্রিত ভারতকে জাগানোর আগুন ছিল তাঁর প্রাণে। শান্তিতে শুয়ে থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। ভারতীয় সন্ন্যাসী হিসেবে সর্বপ্রথম বিশ্বের আঙিনায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের সাজি নিয়ে গেলেন। বিশ্ব ধর্মসভায় বিশ্বমাঝে স্বাতন্ত্র্যের আসন তৈরি করার শিক্ষা দিলেন।
বাঙালি বিপ্লবীর পাশাপাশি বিপ্লব বিরোধী ব্রিটিশ স্তাবকেরাও বাংলায় বসবাস করতেন। এই বৃটিশ স্তাবকতাকে ব্যঙ্গ করে সুকুমার রায় লিখেছিলেন, “হুঁকো মুখো হ্যাংলা/বাড়ী তার বাংলা।” এই হ্যাংলা বাঙালি বৃটিশ প্রভুর জুতো চাটতো আর ব্রিটিশরা তাদের ‘নেটিভ’ বলে ঘৃণা করতো। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন ট্রেনে উঠে পড়েন বৃটিশদের কামরায়, কামরায় বসে ছিলেন দুজন সাদা সৈন্য। স্বামীজিকে দেখে এক সৈন্য তাঁর বুদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, “The Ass is coming”. অন্য সৈন্য তাঁর শ্যামলা গাত্রবর্ণ দেখে বলেন, “No, there is a goat.”
স্বামীজি ধীর গতিতে এসে তাঁদের মাঝখানে বসলেন এবং দু’জনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “I am sitting between the two.” স্বজাত্যবোধের এই প্রতিবাদ আজকের যুবকদের শিখতে হবে তাঁর জীবনাচরণ থেকে।
ভারতমাতার এক স্বরূপ হচ্ছেন মহাকালী, যিনি ব্রহ্মময়ী, তিনিই দেশমাতৃকা, তিনিই ভারতমাতা। তাই দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ছিল বিপ্লবীদের এক মহাশক্তির আধার। সিস্টার নিবেদিতার ‘Kali the Mother’ কবিতার আদর্শে ভারতমাতার ছবি আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ। সেই অখণ্ড ভারতবর্ষের সাধনায় ব্রতী হলেন অরবিন্দ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখছেন, “চল সমরে দিব জীবন ঢালি–/জয় মা ভারত, জয় মা কালী!”
১৯০৮ সালের ২ মে মানিকতলা বোমা মামলার অন্যতম আসামিকে ৪৮ নং গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ সুপার ক্রেগান সাহেব অরবিন্দের শিয়রের কাছ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন, দক্ষিণেশ্বরের পবিত্র মাটি পরিপূর্ণ একটি পাত্র। অগ্নিযুগের বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন, তাঁর রক্তে যে চির বিপ্লবের নেশা, তা স্বয়ং স্বামীজির স্পর্শে সঞ্জীবিত। পক্ষান্তরে স্বামীজি এই শক্তি পেয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে৷ তাই বোমা-বিপ্লবীদের আদানপ্রদান ও মত বিনিময়ের গুপ্ত ঠিকানা ছিল দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতলার নির্জন স্থল। তারই পাশে আড়িয়াদহের বাচস্পতি পাড়ায় এক পুরনো নির্জন বাড়িতে একদা তৈরি হত বোমাবারুদ; তা বিপ্লবীরা ছড়িয়ে দিতেন ভারতের নানাস্থানে।
যিনি ‘বীর সন্ন্যাসী’ হবেন, তিনি কীভাবে মেনে নেবেন আপন জাতির পরাজয়ের দৃশ্যপট? তাঁর মতো সন্ন্যাসীর পক্ষে ব্রিটিশ গোলামি মেনে নেওয়া তো অসম্ভব! তাই তিনি নানান ভাবে দেশবাসীর শক্তি সংহতির কথা বললেন, জাতিকে শক্তিশালী হওয়ার পরামর্শ দিলেন এবং বললেন, আগামী ৫০ বছর দেশমাতৃকাই হবে ভারতবাসীর একমাত্র পূজ্য দেবতা, যাতে দেশবাসী লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করে নিজেরাই নিতে পারে। সেজন্যই সম্ভবত শরীরচর্চার পরামর্শ দিলেন, মানসিকভাবে সবল হওয়ার পরামর্শ দিলেন।
স্বামীজী বলেছেন, “This world is the great gymnasium where we come to make ourselves strong.” রাজযোগ গ্রন্থে আছে, এই দেহই আমার শ্রেষ্ঠ যন্ত্র, শ্রেষ্ঠ সহায়, চিন্তা করিবে — ইহা বজ্রের ন্যায় দৃঢ়,…. দুর্বল ব্যক্তি কখনও মুক্তিলাভ করিতে পারে না। সর্বপ্রকার দুর্বলতা পরিত্যাগ কর। শরীরকে বলো — তুমি বলিষ্ঠ। মনকে বলো — তুমি শক্তিধর ; এবং নিজের উপর অসীম বিশ্বাস ও ভরসা রাখো। স্বামীজী বলছেন, ” Strength is life; weakness is death.Strength is felicity, life eternal, immortal; weakness is constant strain and misery, weakness is death.” বলছেন, “আমি এমন মানুষ চাই, যাদের মাংসপেশী লোহা দিয়ে তৈরি, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরি আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত।”
তিনি মনে করতেন দুর্বলতাই পাপ। শুভঙ্করী কাজে শক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন। জগতের কল্যাণের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য শক্তির প্রয়োগই হচ্ছে ধর্ম। তাই তাড়াতে হবে অলসতা, অকর্মণ্যতা। শরীর মনকে সতেজ রাখতে, জীবনকে গতিময় ছন্দে আনতে খেলাধূলা করতে হবে, শরীর চর্চা করতে হবে। এবং এই কাজ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই করা দরকার। স্বামীজী মনে করতেন শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের এক তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ।
আমরা যে একসঙ্গে মিলতে পারি না, পরস্পরকে ভালোবাসি না, তোতাপাখির মত কথা বলে যাই, আচরণে পশ্চাৎপদতা দেখাই – তার আসল কারণ হল, আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল।
তিনি ইচ্ছাশক্তির একত্র সম্মিলন, এককেন্দ্রিকরণের কথা বলেছেন। বলেছেন, ভারতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে হলে এই সংহতি, শক্তিসংগ্রহ ও বিভিন্ন ইচ্ছাশক্তির একত্র মিলন ঘটাতে হবে। উদাহরণ দিচ্ছেন — চার কোটি ইংরাজ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর উপর কীরূপে প্রভুত্ব করিতেছে? ইহার উত্তর কি? এই চার কোটি ইংরাজ তাহাদের সমুদয় ইচ্ছাশক্তি একযোগে প্রয়োগ করিতে পারেন, এবং উহার দ্বারাই তাঁহাদের অসীম শক্তিলাভ হইয়া থাকে; তোমাদের ত্রিশ কোটি লোকের প্রত্যেকের ভাব ভিন্ন ভিন্ন। ঋগ্বেদ সংহিতা উদ্বৃত করে বলছেন একচিত্ত হওয়াই সমাজ গঠনের রহস্য। তোমরা মিলিত হও, বিরোধ কোরো না। তোমরা সকলে এক অন্তঃকরণ বিশিষ্ট হও। দেবতারা একমনা হয়েই যজ্ঞভাগ লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেবতারা একচিত্ত বলেই মানুষের উপাসনার যোগ্য।
স্বামী বিবেকানন্দকে তাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন মহান প্রেরণা বলে উল্লেখ করতে হয়।