হোমরাজ্যতবু অনন্ত জাগে তিমির অবগুণ্ঠনে

তবু অনন্ত জাগে তিমির অবগুণ্ঠনে

তবু অনন্ত জাগে তিমির অবগুণ্ঠনে

অমিত মিত্র
বার বার মৃত্যু এসে কড়া নেড়েছে তাঁর জীবনে। একের পর এক প্রিয়জন, কাছের মানুষের চির-বিয়োগ প্রত্যক্ষ করেছেন। আর প্রতিবারই সেই মৃত্যু থেকে জন্ম নিয়েছে তাঁর সৃষ্টি। তবু অনেক মৃত্যুর মধ্যে এক মৃত্যু কবির জীবনে যেন এক স্ফুলিঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছিল। জীবনের গভীরে জ্বলে ওঠা এক স্ফুলিঙ্গ। যে মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) সামনে একটি বন্ধ দরজাকে যেন খুলে দিল; আচমকা এবং অপ্রত্যাশিত। তিনি দেখা দিলেন তীব্র এক বৈরাগী শিখার মতো…

একটি নিথর দেহ। আত্মহত। পড়ে আছে ঠাকুরবাড়ির সুরম্য অন্দরমহলে। সেখানে আরও অনেক মানুষজন। কানাকানি। রটনা। সেই দেহ থেকে সামান্য তফাতে, সেই বাড়িতেই আছেন তিনি। সদ্য-বিবাহিত। তেইশ বছরের তরুণ, রবীন্দ্রনাথ।

কাদম্বরী দেবী (Kadambari Devi)। রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠান। ওই একটি মৃত্যু, একটি মুহূর্ত একটি প্রাণকে শুধুমাত্র স্তব্ধ করেনি। আমূল বদলে দিয়েছিল অন্য একটি জীবনকেও। এতটাই যে, দৃশ্যত যেখানে শুধু কালো, সেই নিশাকাশের ভিতরেও তিনি অনুভব করছেন একটি সত্তা। একটি স্পন্দমান বিচ্ছেদ যেন এলোমেলো করে দিচ্ছে তাঁর জীবনপথের সমূহ নকশা।

মৌন কবি। সেই মৌনতা প্রলম্বিত হতে থাকল ক্রমে। জীবনের অন্তভাগ পর্যন্ত। লিখিত, উচ্চারিত, সুরারোপিত এবং অনুচ্চারিত অজস্র শব্দের উপর দাঁড়িয়ে তিনি সেই গভীর নীরবতাটিকেই নির্মাণ করে চললেন শুধু। “এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে”-শুধুমাত্র তো গান হয়েই রইল না। গানের তানে লুকিয়ে থাকা যেন এক আত্মকথন।

একটি নিস্পন্দ শরীরের সঙ্গে কবির যেন শুরু হল এক কথোপকথন, সংলাপ। যে সংলাপ, কথোপকথন চলল রবীন্দ্রনাথের বাকি জীবনের সৃষ্টি জুড়ে। “তিমির অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি, কে তুমি ?/ কে তুমি মম অঙ্গনে, দাঁড়ালে একাকী”, কিংবা “রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে”- কে এই তুমি? যার জন্য রবীন্দ্রনাথের এই আকুলতা! তাঁর সৃষ্টি জুড়ে রবীন্দ্রনাথ একের পর এক গদ্যে, কবিতায়, গানে প্রকাণ্ড এক নীরবতার সঙ্গে কথা বলে গেছেন যেন। সবের মধ্যে একটি ফাঁকা ঘর, একটি নিষ্প্রাণ দেহ যেন তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। তিনি দেখছেন কি? তাঁকে ঘিরে আছে অজস্র লোক, শব্দেরা খেলা করছে তাঁর মননে। কখনও তিনি গগন অন্ধকারে নিদ্রামগন, কখনও বা স্বপ্নপ্রদোষে।

স্থান, কাল যাই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিয়রে যেন বসে রয়েছে নিমেষহত কাল। তাঁর তেইশ বছর বয়সের শোক। অন্ধকারের মধ্যে জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদে হেঁটে বেড়াচ্ছেন তিনি, একলা। যেন জীবনের সমস্ত গ্রন্থি শিথিল হয়ে গিয়েছে। এক গভীর শোক। সেই শোকের মূর্তি ধরে আরও একজন কবির জীবন চরাচরে বোধকরি জাগ্রত। তাঁর স্ত্রী। নিতান্ত কিশোরী। মৃণালিনী দেবী।

এ যেন এক নিঃশর্ত সমর্পণ! ধূসর নরম আলো বিছানো চরাচর। না রাত না দিন। ছায়া ছায়া অচেনা গাছ। অচেনা ফুলের গন্ধ। আকাশ জল ঝরায় কিন্তু কেউ ভেজে না। অস্পষ্ট দিগন্তরেখার দিকে এক আলোকিত প্রাণ ধীরে হেঁটে চলেছেন, সাদা কালো ওয়াশে আঁকা, কোনও রং নেই আর। তবু কী বর্ণময় দ্যুতি! আবহসঙ্গীত বাজে, ‘‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে…’’। কোনও উচ্চকিত শব্দ নেই। কেউ আঁচলে চোখ মুছলে কানে বাজে, ‘‘নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ/ সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে’’। পায়ের কাছের ঝরাফুল কুড়িয়ে প্রিয়জন যখন দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে পারে না, তখন তার কর্ণকুহরে কেউ গেয়ে চলে, ‘‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই/ কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু কোথা বিচ্ছেদ নাই…’’।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img