উত্তরবঙ্গ কি এবারও তৃণমূলকে খালি হাতে ফেরাবে? নাকি সব হিসেব উল্টে যাবে? ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহ দক্ষিণ এবং মালদহ উত্তর – উত্তরবঙ্গের এই ৮টি আসনের মধ্যে ৭টিতেই জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। একমাত্র মালদহ দক্ষিণ আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস।
রাজ্যে ৭ দফার নির্বাচনের প্রথম পর্বে (১৯ এপ্রিল) জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে ভোট হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় (২৬ এপ্রিল) ভোট নেওয়া হয়েছে দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, বালুরঘাটে। ৭ মে তৃতীয় দফায় মালদহ উত্তর ও মালদহ দক্ষিণে ভোট হবে।
দার্জিলিং: প্রথমেই আসি দার্জিলিংয়ের কথায়। এখনও পর্যন্ত লোকসভার এই আসনটিতে একবারও জিততে পারেনি তৃণমূল। পাহাড়ি দলের সমর্থন নিয়ে এই কেন্দ্রে পর পর তিন বার জিতেছেন পদ্মের প্রার্থীরা। এ বারেও সুবাস ঘিসিংয়ের গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সমর্থনেই লড়ছে বিজেপি। সঙ্গে রয়েছে বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও।
স্বাধীনতার পর কংগ্রেস এখানে জিতলেও, পরে তা সিপিএমের দখলে যায়। ১৯৭১, ১৯৮০ ও ১৯৮৪ এবং ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে পরপর তিন বার এখানে জয়ী হয় সিপিএম। এরপর ২০০৪ সালে কংগ্রেস জিতলেও, ২০০৯-এ দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হন বিজেপি-র যশোবন্ত সিং। কিন্তু পরের বারেই প্রার্থী বদলায় বিজেপি। ২০১৪ সালে সাংসদ হয়ে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হন সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। আবার ২০১৯-এ আলুওয়ালিয়াকে বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী করে দার্জিলিঙে দাঁড় করানো হয় মণিপুরের বাসিন্দা রাজু বিস্তাকে। এবার রাজুর বিরুদ্ধে লড়ছেন তৃণমূলের গোপাল লামা। দার্জিলিংয়ে এবার বিজেপির বড় ‘কাঁটা’ হলেন দলেরই কার্শিয়াংয়ের বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। কোনও ‘ভূমিপুত্র’কে পাহাড়ে প্রার্থী করার দাবি তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু দল সে দাবি না-মানায় নির্দল হয়ে দলেরই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বিষ্ণুপ্রসাদ। তাই এবার দার্জিলিংয়ে খেলা ঘুরে যেতে পারে।
২০১৪ সালে বিজেপি দার্জিলিংয়ে জিতেছিল ১,৯৭,২৩৯ ভোটে। ২০১৯ সালে তা বাড়িয়ে ৪,১৩,৪৪৩ ভোটে জেতেন রাজু। বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ৪২.৭৩ থেকে বেড়ে হয় ৫৯.১৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তৃণমূল দার্জিলিঙে পেয়েছিল ২৬.৫৬ শতাংশ ভোট। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমে হয় ৪৩.৬৮ শতাংশ। অন্যদিকে, তৃণমূলের ভোট বেড়ে পৌঁছে যায় ৩১.৩৭ শতাংশে। দার্জিলিং যে তাঁর বিশেষ নজরে রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। বারবার তিনি ছুটে গিয়েছেন পাহাড়ে। তবে এ বার বিজেপি জিতলে দার্জিলিংয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হবে। এই প্রথম সেখানে টানা চার বার জয়ী হবে কোনও দল। আর পর পর দু’বার সাংসদ হওয়ার কৃতিত্ব পাবেন রাজু।
কোচবিহার: দার্জিলিংয়ের মতোই বিশেষ নজরে রয়েছে উত্তরবঙ্গের আরেক কেন্দ্র কোচবিহার। ১৯৭৭ সাল থেকে টানা আটটি লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জিতেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী অমরেন্দ্রনাথ রায় প্রধান। সব মিলিয়ে এই আসনে ১২ বার জয়ী হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এখানে জয়ী হন তৃণমূল কংগ্রেসের রেনুকা সিং। ২০১৯ সালে এই আসনে জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন নিশীথ প্রামাণিক। তবে এবার তাঁর জয় খুব একটা সহজ হবে না। যদিও এখানকার সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থীরা। ২টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে। এই হিসেব এবার উল্টে যেতে পারে। কারণ, দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে নিশীথের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন দলেরই একটা বড় অংশ, যা তৃণমূলকে বাড়তি ফায়দা দেবে।
বালুরঘাট: উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে লড়ছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছেন হরিরামপুরের বিধায়ক তথা রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য বিপ্লব মিত্র। রয়েছেন আরএসপি-র জয়দেব সিদ্ধান্ত-ও। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই আসনটিতে টানা জিতে এসেছে আরএসপি।
২০১৪ সালে বালুরঘাট লোকসভায় প্রথমবার জয়ী হয় তৃণমূল। লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী করেছিল নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আরএসপি তিন লক্ষের বেশি ভোট পায়।
কিন্তু গোটা ছবি বদলে যায় ২০১৯ সালে। আরএসপি চলে যায় তৃতীয় স্থানে। বিজেপি চলে আসে এক নম্বরে। তৃণমূলের অর্পিতাকে হারিয়ে দেন রাজনীতিতে ‘নবাগত’ সুকান্ত মজুমদার। ২.৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে সুকান্ত হারিয়ে দেন অর্পিতাকে। এবার আরএসসি ভোট কাটলে, সুকান্তের জয় অত্যন্ত কঠিন হবে। বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীন ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৪টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে। বাকি তিনটিতে বিজেপি। দীর্ঘদিনের আরএসপি-এর শক্ত ঘাঁটিতে এবার তৃণমূল এবং বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
রায়গঞ্জ:উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে এবার তিন ‘দলবদলু’ প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হচ্ছে। ২০১৯ সালে এই আসন থেকে জিতে বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু দেবশ্রী লড়ছেন কলকাতা দক্ষিণে। রায়গঞ্জে এ বার বিজেপি প্রার্থী করেছে তৃণমূল থেকে আসা কার্তিক পালকে। একটা সময়ে তিনি কালিয়াগঞ্জ পুরসভায় তৃণমূলের চেয়ারম্যান ছিলেন। পক্ষান্তরে, তৃণমূল প্রার্থী করেছে ২০২১ সালে বিজেপির টিকিটে রায়গঞ্জ বিধানসভা আসনে জয়ী কৃষ্ণ কল্যাণীকে।
এবার রায়গঞ্জে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের আলি ইমরান রম্জ। রাজ্য রাজনীতিতে যিনি বেশি পরিচিত ‘ভিক্টর’ নামে। ভিক্টর প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ ভাগাভাগি হতে পারে। তাতে বিজেপির কতটা লাভ হতে পারে, সেদিকেই নজর রাজনৈতিক মহলের। ।
২০১৯ সালে রায়গঞ্জে বাম-কংগ্রেস জোট ছিল না। ২০০৯ সালে এই আসনে জিতে সংসদে গিয়েছিলেন দীপা দাশমুন্সি। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্ত্রী দীপা জিতেছিলেন লক্ষাধিক ভোটে। তার আগে পর পর দু’বার রায়গঞ্জ থেকে সাংসদ হয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। হাজার চল্লিশ ভোট পেয়ে বিজেপি ছিল তিন নম্বরে। ২০১৪ সালে সিপিএম প্রার্থী করে মহম্মদ সেলিম সামান্য ভোটে দীপাকে হারিয়ে দেন। ২০১৯ সালে দেবশ্রী জেতেন ৬০,৫৭৪ ভোটের ব্যবধানে। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিধানসভার ৭টি আসনের মধ্যে ৪টিতে এলাকায় এগিয়ে ছিল বিজেপি। কিন্তু বিধানসভার ভোটে জয় মেলে দু’টি আসনে – কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জে। কিন্তু ওই দুই বিধায়কই (সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যাণী) এখন যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।
আলিপুরদুয়ার: আলিপুরদুয়ারে চা বাগান শ্রমিকরাই বড় ভোটব্যাঙ্ক। ১৯৭৭ থেকে টানা ১০ বার এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল বামফ্রন্টের শরিক আরএসপি। ২০১৪ সালে আরএসপি-কে হারিয়ে তৃণমূলের দশরথ তিরকে জয়ী হলেও, ২০১৯-এ তাঁকে হারতে হয় বিজেপির জন বার্লার কাছে। ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি কেন্দ্রই দখল করেছিল বিজেপি। তবে খাতায়কলমে বিজেপি বিধায়ক হলেও, এখানকার সুমন কাঞ্জিলাল বর্তমানে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাই এই আসনেও বিজেপি পুরোপুরি নিরাপদ নয়।
মালদহ উত্তর: মালদহ উত্তরে এবারও প্রার্থী হয়েছেন গতবারের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। এবছর এই কেন্দ্রের তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে আইএসএফ-এর প্রার্থী হয়েছেন মহম্মদ সোহেল বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী হলেন মোস্তাক আলম। গত বিধানসভার নির্বাচনে এখানে ৪টি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল। বাকি তিনটি যায় বিজেপির দখলে।
২০০৯-এ আসন পুনর্বিন্যাসে মালদহ লোকসভা কেন্দ্র ভেঙে তৈরি হওয়া এই আসনে দু’বার জয়ী হন প্রয়াত গনি খান চৌধুরীর বোনঝি কংগ্রেস প্রার্থী মৌসম নুর। ২০১৯-এ দল বদলে তিনি তৃণমূলের প্রার্থী হন। কিন্তু প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মুর কাছে হেরে যান মৌসম। প্রায় ৮০ হাজার ভোটে জয়ী হন খগেন। তাই এই আসনে এবার তীব্র লড়াইয়ের সম্ভাবনা।
মালদহ দক্ষিণ: ২০০৯-এ আসন পুনর্বিন্যাসে তৈরি হওয়া মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে গত তিনটি (২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯) লোকসভা ভোটে জিতেছেন প্রয়াত গনি খান চৌধুরীর ভাই কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে মালদহ দক্ষিণ লোকসভার অন্তর্গত শমসেরগঞ্জ (যেটি মুর্শিদাবাদ জেলায় পড়ে) ছাড়া অন্য কোনও বিধানসভায় ২০ শতাংশও ভোট পাননি কংগ্রেস-বাম জোটের প্রার্থীরা। ইংরেজবাজারে বিজেপি এবং বাকি ছ’টিতে তৃণমূল জয়ী হয়।
২০১৯ সালে আবু হাসেম খান চৌধুরী ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৭০ ভোট পেয়েছিলেন আবু হাসেম খান চৌধুরী। বিজেপি-র শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোট। এবারও প্রার্থী হয়েছেন শ্রীরূপা। অন্যদিকে, কংগ্রেস প্রার্থী করেছে ঈশা খান চৌধুরীকে। এখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন শাহনওয়াজ আলি রেইহান।
সব মিলিয়ে বলা যায়, উত্তরবঙ্গে লোকসভার ৮টি আসনের মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রেই তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তৃণমূল অন্তত ৪ থেকে ৫টি আসনে জিততে পারে।