অমিত মিত্র
মৃত্যুর ছোবল সামনে থেকে দেখার দুর্ভাগ্য সকলের হয় না। করালগ্রাস বড় ভয়ঙ্কর। শোকাবহ তৈরি করার সামান্যতম সুযোগটুকুও সে দেয় না। নিমেষে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় সেই মানুষটাকে, যাকে একটু আগেও হাসতে দেখা গেছে। চলে ফিরে বেড়াতে দেখা গেছে। এমনকি মাঠে খেলতে দেখা গেছে!
একটি ঘটনা। আর তাতেই যেন কয়েক লহমায় এক হয়ে গেল অতিমারীর ঘনান্ধকারে ঢাকা পৃথিবীটা। কোথাও যেন আপামর মানবজাতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠল কোপেনহেগেনের ফুটবল (UEFA) স্টেডিয়াম। শুধু ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের (Christian Eriksen) পড়ে যাওয়ায়! এরিকসেনের অসুস্থতায়!
এরিকসেন পড়ে যাওয়ার পর সারা পৃথিবীতে যেন নিমেষে ভেসে এল মনখারাপের খবর। এরিকসেনের মাটিতে পড়ে যাওয়া মিলিয়ে দিল যেন গোটা পৃথিবীকে। পরের বেলজিয়াম-রাশিয়া (Belgium-Russia) ম্যাচে শুরুর দশ মিনিটে গোল করে সে গোল রোমেলু লুকাকু উৎসর্গ করলেন ইন্টার মিলানে তাঁর সতীর্থ ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনকেই। এরিকসেন একা শুধু অসুস্থ হন নি, সঙ্গে একজোট করে দিয়ে গেলেন গোটা একটা অসুস্থ পৃথিবীকে। দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে এটাই সোনার লিখন হয়ে রইল।
এরিকসেনের ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন অধিনায়ক। বিবিসি ক্ষমা চেয়ে নিল সেই সময় ক্যামেরা বাইট করার জন্য। ফেসবুক জুড়ে শুরু হয়ে গেল গোটা বিশ্বের প্রার্থনা। দু’দিকে দুটো সাদা কাপড়ের আড়ালে ডেনমার্কের এরিকসেন চললেন হাসপাতালে। সঙ্গে তাঁকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর প্রতিটি সতীর্থ!
এরিকসেন মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর রেফারি খেলা স্থগিত রাখার নির্দেশ দিলেন। আর তখনই একদিক থেকে সমস্ত ফিনিশগণ একত্রে চেঁচিয়ে উঠল – ক্রিশ্চিয়ান! উল্টোদিক থেকে সমস্ত ডেনিশ একযোগ কণ্ঠ মেলালো– এরিকসেন! পালা করে চলল গোটা মাঠ জুড়ে এরিকসেনের জন্য এই প্রার্থনা। এই অসম্ভব মন খারাপ করা পৃথিবীতে আবার নতুন সূর্যোদয়ের সন্ধান বোধহয় সেই ওই মুহূর্তটাই দিয়ে গেল!
প্রথম ম্যাচে হারা, পয়েন্ট খোয়ানো- এই শুকনো পরিসংখ্যান নিয়ে আজ আর তেমন কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। ডেনমার্ক আজ আক্ষরিক অর্থে জিতে গেছে। জিতে গেছে তারা গোটা পৃথিবীর মন। যে যেখানে পেরেছে, এক টুকরো মেসেজ দিয়েছে, দিতে চেষ্টা করেছে তার প্রিয়জনকে। ‘কেমন আছ? ভাল?’ শুধু এইটুকু কথা আমরা কখনও হয়তো বলার সুযোগই পাই না। এরিকসেনের মৃত্যুছোবল যেন সে কথা বলার সুযোগ করে দিল এক নিমেষে। যারা হয়তো কখনও ফুটবল দেখেন না, তাঁরাও সামিল হয়েছেন প্রার্থনায়! পৃথিবীর এই গভীর দুঃসময়ে এ তো মানবতার জয়গাথা; যা ফুটবলের দুনিয়া পেরিয়ে হয়ে উঠল বিশ্ব-মানবের।
