বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়
ঊনিশ শতকে রেনেসাঁর স্বর্ণযুগে কলকাতা তথা ভারতবর্ষ পেয়েছিল এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিকে। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যিনি ছিলেন দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য ও বিদ্যার ঐশ্বর্যের প্রতীক। তিনি তাঁর সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে ছিলেন। সেইসময় অনেকেই মনে করতেন, তিনি বাঙালি পণ্ডিত, আসলে সাহেব। তার কারণ, বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহেবদের গুণগুলি গ্রহণ করেছিলেন।
সারাটা জীবন জুড়ে অসংখ্য কাজ। অথচ মৃত্যু পর্যন্ত একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। অন্য বৃহৎ কাজগুলোর কথা বাদ দিলাম, মেট্রোপলিটন কলেজ একাই চালিয়েছেন আমৃত্যু। সারা জীবনটাই কাটিয়েছেন দরিদ্র ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার প্রসার এবং বিধবা বিবাহ আইন চালু করার অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে।
গ্রামে গ্রামে গরিব বালিকাদের জন্য ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নর্মাল স্কুল, মেদিনীপুর,বর্ধমান, হুগলি, নদীয়ায় মডেল স্কুল স্থাপন। এমনকি বেসরকারি কলেজের সূচনা তাঁর হাত দিয়েই – যা এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ। অথচ বরাবরের এই নিঃসঙ্গ মানুষটি জীবনের শেষদিকে সমকালীন সমাজের কিছু মানুষের কাজকর্মে তিতিবিরক্ত হয়ে কার্মাটোড়ে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। যেখানে সরল, গরিব সাঁওতালরাই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। তবে হ্যাঁ, কালীপ্রসন্ন সিংহ, অক্ষয় কুমার দত্ত, প্যারীচরণ সরকারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল অটুট ও অমলিন। আবার ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা সর্বজনবিদিত।
তাঁর সমসময়ে বঙ্গের বিভিন্ন বিদগ্ধ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক, সখ্যতা, বন্ধুত্বের দিকটা এবার দেখার চেষ্টা করব। বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজে সচেতনভাবে কখনও ধর্ম নিয়ে আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু রামকৃষ্ণ তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে এলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা তাঁর কথা মন দিয়ে ও আগ্রহের সঙ্গে শুনেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের সৌজন্যে দুজনের বাক্যালাপ আজ প্রায় সকলেরই জানা। আবার ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার অগ্রগতি, সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সামাজিক উন্নতি।
বিদ্যাসাগরও ছিলেন একই ভাবধারার পথিক। তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে শ্রদ্ধা করতেন, আবার তিনিও বহু ব্রাহ্মকে শ্রদ্ধা করতেন। ১৮৩৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র সদস্য ছিলেন বিদ্যাসাগর, অ-ব্রাহ্ম হয়েও। ব্রাহ্মসমাজের রাজনারায়ণ বসু, অক্ষয় কুমার দত্তের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। মনে রাখতে হবে, বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনী-লেখক চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। আবার পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্যই বিদ্যাসাগরের প্রতি অতীব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর নানা লেখায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
১৮৫৯ সালে কেশবচন্দ্র সেন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে কলুটোলার বাড়িতে ‘বিধবা বিবাহ’ নাটক অনেকবারই মঞ্চস্থ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই নাটক একাধিকবার দেখেছেন এবং আপ্লুত হয়েছেন। ব্রাহ্মসমাজে তাঁর সব থেকে বেশি সখ্যতা ছিল শিবনাথ শাস্ত্রী ও বিজরকৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে। শিবনাথ শাস্ত্রীও অসম্ভব অনুরক্ত ছিলেন বিদ্যাসাগরের প্রতি। শুধু শিবনাথই নন, তাঁর মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে ছিল বিদ্যাসাগরের দারুণ বন্ধুত্ব। দ্বারকানাথের পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এর মুখ্য পরামর্শদাতা ছিলেন বিদ্যাসাগর।
এবার বলতে চাই ঊনিশ শতকের অন্যতম বর্ণময় মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব নিয়ে। অনেকের মতে, বিদ্যাসাগর বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃত হতে পারতেন না মধুসূদন। যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তখনই মধুসূদন বিদ্যাসাগরের কাছে হাত পেতেছেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও অকাতরে অর্থ যুগিয়েছেন মধু কবিকে। ব্যারিস্টারি পাশ করে মধুসূদন যে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন, তাঁর পিছনেও বিদ্যাসাগরের সাহায্য।
বিদ্যাসাগরকে করুণাসাগর আখ্যা দিয়েছিলেন মধুসূদনই। কিন্তু পরের দিকে মধুসূদনের প্রবল অমিতব্যয়, বিলাসপ্রিয় জীবন, মদ্যপান প্রভৃতি তাঁকে বিরক্ত ও নিরাশ করে তুলেছিল। তাই ১৮৬৮ সালের পর থেকে সাহায্য-দানে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি নিজেই তখন ক্রমশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন অসুস্থতা ও নানাবিধ কারণে। তাহলে নিজে সমস্যায় জর্জরিত হয়েও মধু কবিকে তিনি সাহায্য করতেন কেন?
আসলে মধুসূদন আর পাঁচটা বিলাসী বাঙালিবাবু নন, সেটা বিদ্যাসাগর মহাশয় বিলক্ষণ বুঝতেন। তাঁর মধ্যে এক অমিত-সম্ভাবনার ছায়া বন্ধুত্বের গোড়াতেই টের পেয়েছিলেন। অনেকেই বলেছেন, মধুসূদন ছন্নছাড়া, নোঙরভাঙা দিকভ্রষ্ট কবি। কিন্তু মেঘনাদ বধ কাব্য, শর্মিষ্ঠা বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের রূপকার ওই কবিকে বিদ্যাসাগরের চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি।
(ফেস বুক থেকে নেওয়া)