(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী । বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)
হীরক কর : গরু পাচার-বেআইনি কয়লার কারবার-অসাধু রাজনৈতিক-পুলিশ-এক শ্রেণীর তোলাবাজ আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং বিনয় মিশ্র, সব যেন এক সৃত্রে গাঁথা, যাকে বলে “নেক্সাস”। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা এই বিনয় মিশ্রই এখন সিবিআইয়ের আতস কাচের নীচে। তদন্তের পর সিবিআইয়ের দাবি, প্রাথমিকভাবে কয়লা পাচার কাণ্ডে টাকার অঙ্কটা ১০ হাজার কোটির আশেপাশে।
সরল মনে প্রকাশ্যে দেখলে বিনয় মিশ্র তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। গত ২৩ জুলাই তাঁকে এই পদে নিয়োগ করেন যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোট থেকেই বিনয় ছিলেন অঙ্কে চোস্ত। অঙ্ক অনার্স নিয়েই পড়াশোনা। মেধাবী, ঝকঝকে ছাত্র বলতে যা বোঝায় তাই। নামের মতোই স্বভাবেও নাকি ছোট থেকেই বিনয়ী। কিন্তু পাচারের পাণ্ডা হিসেবে তাঁকে সিবিআই ধরতে আসবে, তাতে বেশ হতবাক পাড়া-পড়শিরা।
কলেজে পড়তেই পড়তেই ছাত্র পরিষদ করতে শুরু করেন বিনয়। তারপর টিএমসিপি। সেই সূত্রেই দক্ষিণ কলকাতার নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এরপর বিনয় প্রাইভেট টিউশন শুরু করেন। অঙ্কের টিউশানি। ছাত্রছাত্রী দক্ষিণ কলকাতার তাবড় ব্যবসায়ীর ছেলেমেয়েরা। বড় বড় ব্যবসায়ীদের বাড়িতে সেই যাতায়াত শুরু। সেই পড়ানোর সূত্রেই এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে পুরুলিয়ার লালার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় তাঁর।
অন্যদিকে এও খবর, বিনয়ের এক আত্মীয় পুলিশের বড় কর্তা। কোলিয়ারি এলাকায় কর্তব্যরত। অভিযোগ, বিনয় ঢাল করেন তাঁকে। পাচারকারীদের অভয় দেন, কারবার চলতে পারে, সমস্যা হবে না। কিন্তু তাঁকেও দেখতে হবে। তাঁকে দেখলে তিনিও দেখবেন। গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি।
এরপর পরিধি বাড়তে থাকে বিনয়ের। অভিযোগ, কয়লা থেকে গরু, বালি পাচারের মাথাদের সঙ্গেও তৈরি হয় ‘নেক্সাস।’ অন্যদিকে ক্রমশ শাসকদলের সর্বোচ্চ সারির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে অঙ্কের মাস্টারের। তৃণমূল ভবন থেকে কালীঘাট, অবাধ বিচরণ ছিল বিনয়ের।
সিবিআই মনে করছে, লালা থেকে এনামুল, গরু থেকে কয়লা কিংবা বালি পাচার—সব চক্রের সঙ্গে রাজনীতির মাথাদের সেতু ছিলেন এই বিনয় । বৃহস্পতিবার সিবিআই তাঁর বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালিয়েছিল। শুক্রবার বিনয় মিশ্রের কৈখালির ফ্ল্যাট সিল করে দেয় কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সি। ৪ জানুয়ারি তাঁকে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরা দেওয়ার নোটিস দিয়েছে সিবিআই।
ছাত্রজীবন থেকেই মুখচোরা বিনয়ের বিরুদ্ধে যে এমন পাচার চক্রের কিংপিন হয়ে ওঠার অভিযোগ উঠবে, তা শাসকদলের অনেক মাঝারি নেতাও বিশ্বাস করতে পারছেন না। আর অনেকে বলছেন, একেই বলে ছুপারুস্তম! এক সময়ে গৃহ শিক্ষকতা করার পাশাপাশি মার্বেলের ব্যবসাও ছিল তাঁর। ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন ছিল।
কিন্তু আচমকাই তাঁর লাইফস্টাইল বদলে যায় উল্কার গতিতে। বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি গাড়ি। শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে মাঝে দেখা যেত। যা নজর এড়ায়নি এলাকাবাসীর। গরু পাচার কাণ্ডে তদন্তে তাঁকে খুঁজছে সিবিআই। বিনয় মিশ্র গরু থেকে কয়লা পাচারের মিডলম্যান হিসাবে কাজ করতেন। বিভিন্ন কয়লা ও গরু মাফিয়াদের থেকে টাকা নিতেন তিনি। সেই টাকা চলে যেত এই রাজ্যের প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে, এমনটাই দাবি সিবিআইয়ের। এমনকি সরকারি অফিসারদের বদলির বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন বলেও অভিযোগ। বিনয় মিশ্রকে এক্স ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়া হত।
বিনয় মিশ্রর বাড়িতে তল্লাশির সময়ে সিবিআই গোয়েন্দাদের সঙ্গে ছিল কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী জওয়ানরাও। এখন পর্যন্ত তার ৪টি বাড়ি-ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা। অভিযোগ, অনুপ মাঝি থেকে শুরু করে বাকি পাচারকারীদের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হবে, এসব বিনয় মিশ্রই দেখত। বিনয় মিশ্র রাজ্যে আইপিএস-সহ প্রশাসনিক অফিসারদের বদলির বিষয়েও নাক গলাতেন। মাফিয়াদের সঙ্গে শাসকদলের শীর্ষ নেতার সেতুবন্ধনও নাকি তিনিই করতেন।
বৃহস্পতিবারের তল্লাশির সময় পাওয়া যায়নি বিনয় মিশ্রকে। রাসবিহারীতে তাঁর বাবার হাতে লুক আউট নোটিশ ধরানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর দাবি, গরু ও কয়লা পাচারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হতেই কলকাতা ছেড়েছেন যুব তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক বিনয় মিশ্র। সিবিআই সূত্রে আরও দাবি, ১৬ সেপ্টেম্বরে শেষ বারের জন্য দেশ ছেড়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত সেপ্টেম্বরেই এনামূল হকের বিরুদ্ধে গরু পাচারের মামলা দায়ের করে সিবিআই ।
সিবিআই সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ২০২০-র ফেব্রুয়ারি থেকেই বারবার দুবাইয়ে গিয়েছেন বিনয় মিশ্র। তিনি শেষবার দেশে এসেছিলেন ৯ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি ১৬ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে যান। তারপর তিনি সরকারিভাবে দেশে ফেরেননি। কিন্তু অন্য কোনওভাবে তিনি দেশে ফিরেছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআই সূত্রে আরও খবর, দুবাইয়ে একটি রিসর্ট কেনার ব্যাপারে কথা চালাচ্ছিলেন বিনয় মিশ্র। তবে তা কি কোনও প্রভাবশালীর জন্য, তাও খতিয়ে দেখছে সিবিআই। দুবাই ছাড়াই শেষবার দেশ ছাড়ার আগে বিনয় মিশ্র সিঙ্গাপুর এবং ব্যাঙ্ককেও গিয়েছেন। সিবিআই-এর দাবি, গরু পাচার চক্রে শুধু রাজনৈতিক নেতাই নন, পুলিশ, আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের একাংশও জড়িত ।
সিবিআই আধিকারিকদের মতে, দুবাই প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ভাল। ফলে প্রত্যর্পণ নিয়ে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কেননা ইতিমধ্যেই বিনয় মিশ্রের বিরুদ্ধে লুকআউট নোটিশ জারি হয়ে গিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেরই প্রশ্ন, তাহলে কি বিনয় মিশ্র কলকাতার মেহুল চোকসি কিংবা নীরব মোদী হয়ে উঠতে চলেছেন ?