হোমPlot1জগতের আদি অনন্ত শক্তি শ্রীশ্রীদুর্গা, সর্বশক্তিরূপে বেদ ও তন্ত্রে বিরাজমান

জগতের আদি অনন্ত শক্তি শ্রীশ্রীদুর্গা, সর্বশক্তিরূপে বেদ ও তন্ত্রে বিরাজমান

জগতের আদি অনন্ত শক্তি শ্রীশ্রীদুর্গা, সর্বশক্তিরূপে বেদ ও তন্ত্রে বিরাজমান

কূলাবধূতাচার্য সোমানন্দ নাথ
আশ্বিনের আকাশ এবং বাতাসে শিউলিফুলের গন্ধ জানান দিচ্ছে উমা আসছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হতে চলেছে দশভুজা মহিষমর্দিনীর আরাধনা। গানে, স্তুতিতে, চন্ডীপাঠে তাঁরই আবাহন, তিনি দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা। বঙ্গের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় তাঁরই আবাহনগীতি।
  

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রয়েছে, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা’ অর্থাৎ তাঁকে সর্বশক্তিরূপে লাভ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।‌ চন্ডীপাঠের মাধ্যমে সেই আদি শক্তিকেই আহ্বান করা হয়। তবে মার্কেণ্ডেয় চন্ডীতে দেবীর অন্যান্য রূপকেও আহ্বান করা হয়, যা অর্গলাস্তোত্রে বর্ণিত রয়েছে। বলা বাহুল্য, এই স্তোত্রের ধ্বনি হলেন ভগবান বিষ্ণু, ছন্দ অনুষ্টুপ এবং দেবতা শ্রীমহালক্ষ্মী।  মূলত, বিশ্বজননীর প্রীতির জন্যই স্তোত্রপাঠ করা, এ এক প্রাচীন ধারা, যা যুগ যুগ ধরে মেনে আসছেন সকলে।

চন্ডীর অন্তর্গত ‘রাত্রিসুক্ত’ ও দেবীসুক্ত’ এই দুটি কিন্তু ঋকবেদের ‘ শাকলসংহিতার’ অন্তর্গত (‘রাত্রিসুক্তে দেবীসুক্তে ঋকবেদশাকলসংহিতানায়ং প্রসিদ্ধে’)। বামনপুরাণ এবং মৎস্যপুরাণে অগ্নিসোমের ‘সোম’ই দেবী কৌশিকী এবং ‘অগ্নি’ হলেন দেবী কালিকা। আবার ঋকবেদে এই অগ্নিসোমের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীশ্রীচন্ডীতে উল্লেখ ‘বাকসুক্ত’, ‘রাত্রিসুক্ত’ ও ‘শ্রীসুক্ত’ থেকেই মহাকালী, মহাসরস্বতী এবং মহালক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটে। তাই আপাতদৃষ্টিতে বেদের সঙ্গে তন্ত্রের তেমন কোন বিরোধ নেই। ঋগ্বেদের বাক্, রাত্রি এবং শ্রী- এই তিনটি সুক্ত এই তিনদেবী রূপে সনাতন হিন্দুধর্মে পূজিতা হন। বেদ থেকে তন্ত্রে, তন্ত্র থেকে পুরাণ, এভাবে নানা রূপে রূপান্তরিত হয়ে এই তিন দেবী বিশ্বজননীর স্থান পেয়েছেন।

এর পাশাপাশি, বেদে যে সপ্তমাতৃকার উল্লেখ রয়েছে, তাঁরা হলেন ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহী, নারসিংহী ও চামুণ্ডা। আবার তন্ত্রের আগমশাস্ত্রে এই সপ্তমাতৃকা হলেন,  শ্রীশ্রী চন্ডী, দুর্গা এবং কালীরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আবার এই শক্তিই দেবী কাত্যায়নীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বৈদিক যুগে দেবী অদিতি, ঊষা, সরস্বতীর পরবর্তীকালে তন্ত্রে বিশেষ প্রকাশ ঘটে।

ডঃ হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য বলেন, “লক্ষ্মী ও দুর্গার উৎস হলেন বৈদিক ‘দিব্য সরস্বতী’। দেবী পার্বতী কিংবা দুর্গা,  ঋকবেদের সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্ন, তা মার্কন্ডেয় পুরাণের মধুকৈটভবধ, মহিষাসুর বধ কিংবা শুম্ভনিশুম্ভ বধ থেকেই প্রমাণিত হয়। প্রথম অংশে দেবী মহাকালী, দ্বিতীয়ে দেবী মহালক্ষ্মী এবং তৃতীয়ে দেবী মহাসরস্বতী। অপরদিকে শ্রীশ্রীচণ্ডীর টীকাকার গোপাল চক্রবর্তী বলেছেন, “সাক্ষাৎ সরস্বতী প্রাপ্তা শুম্ভাসুরনিসূদিনী ইতি যামলে’, অর্থাৎ, রুদ্রযামল তন্ত্রে বেদোক্ত সরস্বতীকে শুম্ভাসুরের হন্তারক বলা হয়েছে। ডামর তন্ত্রেও অষ্টপূজা মহাসরস্বতীর উল্লেখ রয়েছে, যিনি শুম্ভাসুরবিনাশিনী হিসেবেই সাধকের কাছে পরিচিত।

সাধকের অন্তরে ঈশ্বর মূলত নিরাকার, রূপহীন। সেই কারণে বৈদিক যুগে আর্যরা ঈশ্বরের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “রূপংরূপ বিবর্জিতসৎ ভবতে ধ্যানেন যদবর্ণিতং’ অর্থাৎ হে রূপবিহীন ঈশ্বর, ধ্যানেই  তোমার আহ্বান করছি। আবার তন্ত্রেও উল্লেখ রয়েছে, মাতৃশক্তিই জগতের আদি। এই নিরাকার ঈশ্বরকে যখন দেবীরূপে কল্পনা করা হয়, তখন ভক্তের মনে পারমর্থিক শক্তির জন্য ঈশ্বরের মাহাত্ম্য ক্ষুন্ন হয় না। তাই বৈদিক ধারায় বলা হয়েছে, “সাধকানাং হিতার্থায়ে ব্রহ্মণে রূপকল্পনা।’ অর্থাৎ সাধকের মঙ্গল বিধানেই ঈশ্বরের নানান রূপ কল্পনা করা হয়েছে।

সপ্তশতী চণ্ডীতেও দেবীর বিভিন্ন রূপের কথা জানা যায়। নানান লীলায় মহামায়া নানান রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। কিন্তু তত্ত্বমতে তিনি এক ও অদ্বিতীয়া  – ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।’ অর্থাৎ নিজের ঐশ্বর্য্য বলেই তিনি বহুরূপে প্রকাশিতা- ‘অহং বিভূত্যা বহুভিরিহ রূপৈর্যদাস্থিতা।’

বৈদিক যুগেও আদ্যাশক্তি মহামায়ার জয়ধ্বনিই বর্ণিত হয়েছে। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ তম সূক্তই দেবী ভগবতীর স্বরূপ এবং মহিমা প্রকাশ করে। সেকালে বৈদিক স্তোত্রকেই সূক্ত বলা হয়। এটিকে আবার দেবীসূক্ত বলেও উল্লেখ করা হয়। এই দেবীসূক্তেই চণ্ডীর মাহাত্ম্য প্রচ্ছন্নভাবে ব্যক্ত হয়েছে। একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, ত্রয়োদশ বিশ্বদেবতা, দিন ও রাত্রির দেবতা মিত্র ও বরুণ এই সমস্ত বৈদিক দেবতাদের রূপে জগজ্জননী পরমা প্রকৃতিই বিরাজ করেন। তিনিই সমস্ত দেবতার আত্মার স্বরূপ। সমস্ত দেবতা তাঁরই অনন্ত শক্তির প্রকাশ। তিনিই সর্বদেবদেবীরূপে বিরাজিতা, তিনিই জগদীশ্বরী, তাঁর শক্তিতেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টি-স্থিতি এবং লয় হয়। সাধকের তিনিই লৌকিক ও অলৌকিক, পার্থিব ও অপার্থিব সমস্ত সম্পদ দান করেন। গৃহীদের ভোগ এবং মোক্ষও দান করেন। তাই দেবীই হলেন সেই ব্রহ্মবিদ্যা স্বরূপিণী।

দেবীসূক্তে ভগবতী বলেছেন, ‘আমি একা অদ্বিতীয়া হয়েও বহুরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছি। সেই আমাকেই দেবতারা সর্ব শক্তিরূপে পূজা করেন।’ বিশ্বজননী আদ্যাশক্তি নিজের কথা নিজ মুখেই বলেছেন। তিনি এও  বলছেন, ‘আমিই যাকে যেমন ইচ্ছা করি তাকে তেমনি ভাবেই সৃষ্টি করি।’ ব্রহ্মা আমার ইচ্ছাতেই জগৎ সৃষ্টি করেন এবং রুদ্রের শক্তিও আমি। ধর্মরক্ষার জন্য অসুর বিনাশ করে সাধকদের আমিই রক্ষা করি।’ গীতাতে যেমন ভগবান বলেছেন, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্/পরিত্রাণায় সাধুনাম বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম/ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।’ ঠিক তেমনি আদ্যাশক্তি মহামায়াও যুগে যুগে ধার্মিকদের রক্ষা করার জন্য অবতীর্ণা হন, কারণ তিনিই সর্বব্যাপী।
   
সেই ব্রহ্মময়ী সাধকের শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা প্রকাশিত হন। বলাবাহুল্য, তিনিই ঐ সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন সাধকের হৃদয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘দৃশ্যতে তু অগ্রয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ।’ অর্থাৎ এই আদি শক্তি পরমা প্রকৃতি নির্বিকারা ও ব্রহ্মচৈতন্যস্বরূপা, তবুও নিজ শক্তিবলে তিনিই সমগ্র জগৎ রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। সেই আদ্যাশক্তি সূক্ষ্মা, স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত রূপে বিরাজিতা। স্বয়ং নিরাকারা হয়েও সাকারা। তিনি কৃপা না করলে কে তাঁকে জানতে পারে? তন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘ত্বমেব সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী/নিরাকারাহপি সাকারা কস্ত্বাং বেদিতুমর্হমি।’

বৈদিক সাহিত্য বাজসনেয়ী সংহিতার এক মন্ত্রে রুদ্রদেবতার সঙ্গীরূপে অম্বিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে তাঁকে রুদ্রের সঙ্গিনী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই যজ্ঞের নাম হলো ত্র্যম্বকহোম। শতপথব্রাহ্মণেও মাতৃদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার তৈত্তিরীয় সংহিতার মন্ত্রেও অম্বিকাদেবীর উল্লেখ রয়েছে। এই অম্বিকাদেবীই তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মন্ত্রে ও শতপথ ব্রাহ্মণের মন্ত্রে ‘শারদী’ বা শরৎকালীন দেবী দুর্গা রূপে আবির্ভূতা হন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে আবার অম্বিকাপতি রুদ্রের কথা পাওয়া যায় এবং এই রুদ্রই ঋকবেদের রুদ্রদেবতা।

একই সঙ্গে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে উমার উল্লেখ মেলে, আর রুদ্র এখানে উমাপতি। কেনোপনিষদেও উমা-হৈমবতীর ধারণা রয়েছে। দেবী উমা সেখানে হিমালয় দুহিতা পার্বতী। হিমময় পর্বতদুহিতা বলে হৈমবতী, আবার পর্বতবাসিনী বলেও তিনি পার্বতী। বৈদিক সাহিত্যের অনেক স্থানে শিবকে গিরীশ ও দেবী উমাকে গিরিজা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শিবের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেখানে দেবীধারণার উল্লেখে ভদ্রকালী, জ্যেষ্ঠা ও দুর্গা শব্দটির উল্লেখও বহুক্ষেত্রে মেলে। মুন্ডক উপনিষদে আবার কালী, করালী, মনোভাবা ইত্যাদি অগ্নিশিখার উল্লেখ রয়েছে, এগুলি বেদোক্ত দেবতা অগ্নির জিহ্বাস্বরূপ। কিছু পুরাণে এই অগ্নিজিহ্বাগুলি দেবী সরস্বতী নামেই পরিচিত। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে কাত্যায়নী, বিরোচনী, কন্যাকুমারী প্রভৃতি নাম পরবর্তীকালে দুর্গাপ্রশস্তিতে পাওয়া যায়।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img