ডাঃ সুভাষ মাইতি
সৃষ্টিকর্তার দুষ্টুমি আর পরজীবীর খেলা। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের জীবনকে শেষ করে দেয়। কেউই তো সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না,তাহলে কেন তারা এই চরম পথকে বেছে নেয়; এটা সবার কাছেই একটা হেঁয়ালি। সহজ উত্তর হল মানসিক বৈকল্য, কিন্তু সেটাই কি একমাত্র কারণ বা তা সত্যি হলেও সেটা কেন ঘটে? শুনলে আশ্চর্য মনে হবে যে, এর পিছনেও সৃষ্টিকর্তার অদৃশ্য হাত রয়েছে। আর এর জন্য দায়ী এক অণুজীবী, যার নাম Toxoplasma Gondii.
কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৪ টি গবেষণার যে নির্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৩০% মানুষ এই জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত। আরও জানা গেল যে, পৃথিবীতে যত মানুষ আত্মহত্যা করেন, তাদের মধ্যে ১০% মানুষের মৃত্যুর কারণ এই জীবাণু। আবার পৃথিবীতে যত পথ দুর্ঘটনা ঘটে, তার ১৭% এর পিছনেও নাকি এই জীবাণু।
কিন্তু প্রশ্ন হল, ৩০% মানুষের মধ্যে যদি এই জীবাণু থাকে, তবে তারা সবাই কেন এর শিকার হয় না। উত্তরটাও সহজ। এই জীবাণু খুবই দুর্বল প্রকৃতির, তাই মানুষের স্বাভাবিক সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সহজেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের আছে, তাদের এই জীবাণু প্রভাবিত করতে পারে না। কেবলমাত্র যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তারাই এর শিকার হয়।
কিন্তু কীভাবে এটা ঘটে, সেটাই হল প্রশ্ন। এই জীবাণু যখন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, তখন এক ধরনের এনজাইম (enzyme) তৈরি করে,যার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন (dopamine) তৈরি করে। সেই ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কের amygdala-র ওপর প্রভাব বিস্তার করে।Amygdala আমাদের বোধ, সংবেদনশীলতা এবং responseকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রচুর পরিমাণে ডোপামিনের ফলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের (neurotransmitter) কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এবং মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা প্রয়োগে অক্ষম হয়।
দেখা গেছে যে এই জীবাণু মানুষের মধ্যে ভয় কমিয়ে দেয়, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব বাড়িয়ে দেয় এবং response কে শ্লথ করে দেয়। ফলে জীবননাশের ভয় কমে যায়, ওভারটেক করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক সময়ে ব্রেক করতে অপারগ হয়ে পড়ে।
কিন্তু এসব পরিবর্তনের কারণ কী? কোনও প্রাণীই মরতে চায় না, তাই বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। একে বিবর্তনের (evolution) ফলও বলা যায়। প্রায় সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই এই জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে, যেমন ইঁদুর,পাখি, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি। কিন্তু এরা হল এই জীবাণুর intermediate host। কারণ এদের মধ্যে এই জীবাণু প্রজননগতভাবে বংশবিস্তার করতে পারে না, যেটা পারে একমাত্র বিড়াল জাতীয় প্রাণীর মধ্যে। তাই বিড়াল জাতীয় প্রাণী হল এদের definite host।
কিন্তু ইঁদুর তো বিড়ালকে ভয় পায়, তাহলে কী করে ইঁদুর থেকে বিড়ালের মধ্যে এই জীবাণুর প্রবেশ ঘটবে? অদ্ভুত ব্যাপার হল যে, ইঁদুরের মধ্যে এই জীবাণু আছে, তাদের ব্রেনের ওপর এই জীবাণুর প্রভাবে বিড়াল সম্পর্কে ইঁদুরের ভয় কমে যায় এবং বিড়ালের প্রস্রাবের ওপর তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয়। ফলে ইঁদুর সহজেই বিড়ালের কাছে চলে যায় এবং বিড়াল অনায়াসেই ইঁদুর শিকার করতে পারে। আর এভাবেই এদের বংশগতি অক্ষুন্ন থাকে।
কিন্তু মানুষের শরীরে এরা কিভাবে প্রবেশ করে? বিড়াল যখন মলত্যাগ করে, তখন তার মধ্যে এই জীবাণুও মিশে থাকে। তা যদি মাঠে হয়,তবে সেখানকার শাকসবজি ও ফলমূল সঠিকভাবে পরিষ্কার বা রান্না করে না খেলে ,সহজেই মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে বা বাড়িতে যদি বিড়াল পোষা হয়, তবে তার থেকেও জীবাণু ঢুকতে পারে। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সঠিক হলে, শরীর এদের মোকাবিলা করতে পারে। তা না হলেই বিপদ, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়। অনাগত বাচ্চার ওপর এর প্রভাব অপরিসীম।
তাহলে কী করণীয়? শাকসবজি, ফলমূল ভালোভাবে পরিষ্কার করে খেতে হবে। মাংস, তা সে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু, যাই হোক না কেন, ভালোভাবে সেদ্ধ করে খেতে হবে।খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
আর এতসব করেও যদি জীবাণুর সংক্রমণ হয়, তখন তো ডাক্তারবন্ধুরা আছেনই। সৃষ্টিকর্তার এ কী দুষ্টুমি বলুন দেখি! প্রাণ দিয়েছেন, আবার বেঁচে থাকার জন্য কায়দাকানুনও শিখিয়ে দিয়েছেন। বেঁচে থাকার অধিকার তো সবারই আছে, শুধু লড়াই করে বাঁচতে হবে।
পৃথিবীর রূপ,রস,গন্ধ,স্পর্শ কে না চায় উপভোগ করতে।তাই আসুন কোমর বেঁধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিই। কারণ সৃষ্টিকর্তার এই জগতে লড়াই ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তাও আমাদের সাথে খেলা খেলছেন। তিনি একইসাথে নিষ্ঠুর আবার পরিহাসপ্রিয়। সৃষ্টিকর্তার দুষ্টুমিতে আমরাও মেতে উঠি আর খেলার আনন্দ উপভোগ করি।