লেখক ➤ তাপস ঘোষ
কল্পতরু হ’ল সেই পৌরাণিক গাছ, যে গাছের কাছে গিয়ে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলছেন :
একটি লোক জঙ্গলে পথ হারিয়ে একটি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত হয়ে ভাবছে, ‘যদি কিছু খাবার পাওয়া যেত।’ গাছটি ছিল কল্পতরু। অমনি একরাশ খাবার লোকটির সামনে এসে গেল।
লোকটি খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ভাবছে, ‘বড় ঘুম পেয়েছে। যদি একটা বিছানা পাওয়া যেত।’
অমনি খাট বিছানা বালিশ সব এসে হাজির।
লোকটি এবার আরাম করে শুয়ে শুয়ে ভাবছে, তাইতো, গভীর জঙ্গলে আছি, যদি বাঘ এসে আমায় খেয়ে যায় তবে কী হবে? যেই না ভাবা, অমনি বাঘ এসে লোকটিকে খেয়ে গেল।
ঠাকুর গল্পটির শেষে শিক্ষা দিচ্ছেন : ঈশ্বরও কল্পতরু, তাঁর কাছে প্রার্থনা করলে তিনি শোনেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে বাঘও আসে।
অর্থাৎ, আমরা ভগবানের কাছে, ধন চাই মান চাই, পার্থিব সুখ চাই। প্রার্থনা আন্তরিক ও যথাযথ ভাবে নিবেদিত হলে, সে প্রার্থনা মঞ্জুরও হয়।
কিন্তু এই প্রার্থনার বস্তুগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে কষ্টের বীজ। প্রার্থিত জাগতিক বস্তুগুলির সাথে সাথেই সেই অনিবার্য দুঃখগুলোও নিতে হয়। তাই সতর্ক হয়ে প্রার্থনা করতে হয়।
নরেন্দ্রনাথকে ঠাকুর পাঠিয়েছিলেন মা কালীর কাছে, জাগতিক ‘প্রেয়’ বস্তু প্রার্থনা করতে। কিন্তু তিনবারের চেষ্টাতেও নরেন্দ্রনাথ তা চাইতে পারলেননা। তিনি প্রার্থনা করলেন ‘শ্রেয়’ বস্তু : জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য। বললেন, ”রাজরাজেশ্বরীর কাছে সংসারের ‘লাউ-কুমড়ো’ চাইতে পারলুমনা।”
— এই হল ঈশ্বরের কাছে যথার্থ প্রার্থনা।
জাগতিক প্রার্থিত বস্তুর সাথে সাথে বাঘও আসে,
যা আমাদেরকে বিনাশের দিকে ঠেলে দেয়।
পয়লা জানুয়ারি আমরা অনেকেই কাশীপুরে যাই। সেই সাজিয়ে রাখা গাছটির কাছে যাই, যেখানে ঠাকুর হয়েছিলেন কল্পতরু।
ঠাকুর নিজেও বলেছেন : ”কল্পতরুর কাছে গিয়ে চাইতে হয়।”
কিন্তু ‘কল্পতরুর কাছে যাওয়ার’ অর্থ কি কোনো সাজিয়ে রাখা গাছের কাছে যাওয়া?
যেখানে তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন সেই কাশীপুর উদ্যানবাটীতে যাওয়া?
না, মনে হয় তা নয়।
তিনি পবিত্রতার স্বরূপ। তাই পবিত্রতার মধ্যে দিয়েই আমরা কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে যেতে পারি। এই পবিত্রতা আসে নিরন্তর জপ ও স্মরণ-মননজাত প্রেমের পথে। পবিত্র প্রেম-চক্ষে শুধু কাশীপুর নয়, সমগ্র জগৎ তাঁরই প্রতিবিম্বস্বরূপ কল্পতরুময় বলে প্রতিভাত হয়। ঠাকুর বলেছিলেন : ‘ভক্তের হৃদয় হ’ল ভগবানের বৈঠকখানা।’
তাই হৃদয়ের পথেই মেলে কল্পতরুর সন্ধান।