হোমভ্রমণগুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা

গুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা

গুপ্তিপাড়ার গুপ্তকথা

দেবস্মিতা নাগ: সহজপাঠে যে গুপ্তিপাড়ার বিশ্বম্ভরবাবুকে দেখা যায়,সেই গুপ্তিপাড়ার কিন্তু অনেক ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে খুঁজে পেতে কোনও এক সপ্তাহান্তে এসে কাছ থেকে দেখে যেতে হবে গুপ্তিপাড়াকে।

হুগলি জেলায় গঙ্গার তীরে ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহর গুপ্তিপাড়া। সেখানে পৌঁছতে হলে হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল চেপে ব্যান্ডেলের পর যেতে হবে আরও মিনিট চল্লিশ। গাড়ি থেকে নেমেই মিষ্টিমুখ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। তার জন্যে রয়েছে ঐতিহাসিক গুপো সন্দেশ,অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির প্রতিপক্ষ ভোলা ময়রার জন্মভিটে বলে কথা।

মিষ্টির পীঠস্থান এই অঞ্চল। গুপ্তিপাড়াতেই জন্ম হয়েছিল বাঙালির বড় আদরের বারোয়ারি পুজোর।শ্রীরামপুরের ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া নামে একটি পত্রিকার1820 সালের মে মাসের সংখ্যায় এই তথ্য প্রকাশিত হয় যে, 1761 সনে এই এলাকার বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী মন্দিরে প্রথম ১২ জন ব্রাহ্মণ মিলে বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজো করে জনসাধারণের খুব কাছাকাছি এনে দেন বাঙালির প্রাণের উৎসবকে।

কথিত আছে, বাংলার শাসক সেনবংশের রাজার বংশধরদের বাড়িতে যে পুজো হতো, যা কিনা আজও হয়, সেই বাড়িতে গিয়ে কোনো কারণবশত এই বারো জন ব্রাহ্মণ অপমানিত বোধ করেন। বচসা হয়,ফলে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনা ঘটে মহাষ্টমীতে। প্রথম বছর বারোয়ারি পূজা শুরু হয় মহানবমী তিথিতে।

গুপ্তিপাড়ার অলিগলিতে মন্দির। আর তার ইটে ইটে ইতিহাস। তাই সেই মন্দিরগুলির দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে খোদ আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হলো ষোড়শ শতকের চৈতন্য মন্দির। টেরাকোটার অপূর্ব কারুকার্য এর গায়ে খোদাই করা আছে। এটি বাংলার আটচালা আদলে তৈরি মন্দির। 1745 খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দি খানের আমলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি জমির কর বকেয়া পড়ায়, জমিটিকে বাঁচাতে সেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির স্থাপন করেন।

এ ছাড়াও এখানে রয়েছে রামচন্দ্র মন্দির। এই মন্দির একচুড়া মন্দির। এর গায়ে রামায়ণের যুদ্ধকান্ড টেরাকোটায় খোদাই করা আছে। তবে কারুকার্যে বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরই এগিয়ে। কথিত আছে, কালাপাহাড়ের আক্রমণের সময় এই বিগ্রহকে বাঁচাতে একটি ছবির পিছনে সেটিকে লুকোনো হয়। সেই থেকে এই জায়গার নাম হয় গুপ্তপল্লী ও পরবর্তীতে গুপ্তিপাড়া।

বিগ্রহ প্রাচীন হলেও এই মন্দির স্থাপিত হয় 1810 সালে। এই মন্দিরের চূড়া 60 ফুট উঁচু। কোনারকের চূড়া ভারতের উচ্চতম রথ মন্দির। বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির তৃতীয় উচ্চতম। এই মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে যে রথযাত্রা বের হয়, তা ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম রথযাত্রা। ওড়িশার রথযাত্রার পরেই। এই রথ সুসজ্জিত নবচূড়া রথ। এই উৎসব ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রথযাত্রা উৎসব।

এই অঞ্চলের স্থানীয় উৎসব ভান্ডারলুট, যা উল্টো রথের দিন অনুষ্ঠিত হয়। এটি এক ধরনের খাদ্যোৎসব। এ ছাড়াও এই অঞ্চলের প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে একটি অন্যতম মন্দির হলো দেশকালী মন্দির।এই মন্দিরে ডাকাতরা উপাসনা করতো। তাদের দেবীর বিগ্রহ নেই। আছে কেবল শাড়ি জড়ানো একটি কাঠামো। আজও মশাল মিছিল করে এই দেবীর বিসর্জন অনুষ্ঠিত হয়। জ্বলে না বিজলি বাতি।

এ ছাড়াও এই এলাকার সূর্য মন্দির বিখ্যাত, যা খুবই বিরল। এলাকার প্রান্তে যেখানে বিস্তৃত গঙ্গা বয়ে চলেছে, সেখানে নীলকুঠির একটি চিমনি আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মূল অট্টালিকার ভগ্নাংশ 2000-এর বন্যায় ভেসে যায়। ওই অঞ্চলটির ভৌতিক দুর্নামও আছে। এর পরেই আছে গুপ্তিপাড়া ঘাট। নদী পেরোলেই শান্তিপুর-ফুলিয়া। কেনাকাটার পীঠস্থান।সব মিলিয়ে রাজোটক সপ্তাহান্ত।

spot_img
spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img