হোমলাইফস্টাইলনেই রোগ, যেখানে শতায়ুরা বাঁচেন মনের আনন্দে, কোথায় লুকিয়ে রহস্য

নেই রোগ, যেখানে শতায়ুরা বাঁচেন মনের আনন্দে, কোথায় লুকিয়ে রহস্য

নেই রোগ, যেখানে শতায়ুরা বাঁচেন মনের আনন্দে, কোথায় লুকিয়ে রহস্য

সুচিক্কণ দাশ : ওকিনাওয়া। জাপানের পঞ্চম বৃহত্তম দ্বীপভূমি। আয়তনে ছোট। লোকসংখ্যাও কম। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগার লাগোয়া এই দ্বীপভূমিতেই রয়েছে মানুষের দীর্ঘ জীবনের রহস্য। এখানেই থাকেন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শতায়ু মানুষেরা। প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় শতায়ু ৬৮ জন।

জাপানের অন্য দ্বীপগুলির তুলনায় শতায়ু মানুষের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেশি। দ্বীপের দুই তৃতীয়াংশ বাসিন্দার আয়ু ৯৪ বছর। এখানখার বাসিন্দাদের হৃদরোগ হয় না বললেই চলে। ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ডিমেনশিয়ার প্রকোপও কম। আসলে এখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন ইকিগাই মতবাদে।

ইকিগাই মানে আনন্দে বেঁচে থাকা, কোনও কিছুর জন্য বেঁচে থাকা। জাপানের সংস্কৃতিতে সব মানুষেরই ইকিগাই আছে। মানে সবারই আনন্দে বেঁচে থাকার একটা কারণ আছে। অর্থাৎ সবার আনন্দের ধারণা এক না হতেও পারে। কিংবা হতেই পারে আলাদা। ইকিগাই থেকেই আসে দীর্ঘ, আনন্দে পরিপূর্ণ একটা আয়ু।
কিন্তু এ তো গেল জীবন দর্শনের কথা।

এছাড়াও কি কোথাও লুকিয়ে আছে এই নীরোগ, দীর্ঘ আয়ুর রহস্য?

বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি বলছেন, এর মূল রহস্য রয়েছে ওকিনাওয়ার বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাসে। এশিয়ার বাসিন্দা হলেও এখানকার বাসিন্দাদের মূল খাদ্য ভাত নয়, মিষ্টি আলু। নেদারল্যান্ড থেকে এই আলু ওকিনাওয়ায় এসেছিল প্রায় ৪০০ বছর আগে। খাদ্য তালিকায় থাকে প্রচুর পরিমাণে সবজি। এছাড়া জাপানের নিজস্ব নানা ধরনের সয়া থেকে তৈরি খাবার। এখানকার লোকেরা শুয়োরের মাংস, মাছ ও নানা ধরনের মাংস খান, তবে তা খুবই কম পরিমাণে।

এখানকার খাবার ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। কিন্তু ক্যালরি কম। ফাস্ট ফুড আসার আগে ওকিনাওয়াবাসীরা সাধারণ জাপানিদের চেয়ে ১১ শতাংশ কম ক্যালরির খাবার খেতেন। এই কম ক্যালরি উপভোগ করাকেই দীর্ঘ আয়ুর রহস্য বলতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। বাঁদরদের ওপর পরীক্ষায় দেখা গেছে, গড় পরিমাণের চেয়ে যেসব বাঁদর নিয়মিত কম ক্যালরির খাবার খায়, তাদের বেশি বয়সের রোগ কম হয়।

চামড়া কোঁচকায় না বলে তাদের বয়সও কম দেখায়। গায়ের লোমের রঙও সাদা হয় না। সম্প্রতি মার্কিন বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, যাঁরা কম ক্যালরির খাবার খান তাঁদের হার্ট অনেক বেশি ভাল থাকে। এমনকি তাঁদের রক্তচাপ ও রক্তে ক্লোরেস্টরেলের পরিমাণও কম। তবে কম ক্যালরির খাবার খেলে কেন আয়ু বাড়ে তার কার্যকারণ সম্পর্ক বিষয়ে বিজ্ঞাীদের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়।

মনে করা হচ্ছে, খাবারে ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করা হলে কোষে এমন কিছু পরিবর্তন হয়, যা দীর্ঘ আয়ু পেতে সাহায্য করে। এছাড়া কার্বোহাইড্রেট বেশি খেলে এবং প্রোটিন কম খেলেও আয়ু বাড়ে বলে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে ফর্মুলা হল, ১০ ভাগ ক্যালরি খেলে প্রোটিন খেতে হবে এক ভাগ। সমীক্ষা বলছে, এই ধরনের খাবার খেলে মস্তিষ্কের কোষে থাবা বসাতে পারে না বয়স। ওকিনাওয়ার বাসিন্দাদের খাদ্য তালিকায় আগে ছিল কার্বোহাইড্রেট ৮৫ শতাংশ। এখন কমে হয়েছে ৫৮ শতাংশ। প্রোটিন ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ। ফ্যাট ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ শতাংশ।

নির্দিষ্টভাবে কী থাকে ওকিনাওয়াবাসীর খাদ্য তালিকায়?

শাকসব্জি (৫৮ থেকে ৬০ শতাংশ)— মিষ্টি আলু, সামুদ্রিক গাছগাছড়া, বাঁশের কোঁড়, মুলো, তোতো তরমুজ, বাঁধাকপি, গাজর, কুমড়ো, কাঁচা পেঁপে ও ঝিঙে।

দানা শস্য (৩৩ শতাংশ) — বাজরা, গম, চাল ও নুডল
সয়া ফুড (৫ শতাংশ) — তোফু, মিসো, নাত্তো ও সেদ্ধ করা নোনতা সবুজ সয়াবীন।

মাংস ও সামুদ্রিক খাবার (১ থেকে ২ শতাংশ) — সাদা রঙের মাছ, সামুদ্রিক মাছ, শুয়োরের মাংস
অন্যান্য খাবার (১ শতাংশ) — অ্যালকোহল , চা, হলুদ, মশলা, যত খুশি জেসমিন টি।

বুঝতেই পারছেন, খাবারের ব্যাপারে কী ধরনের সংযম মেনে চলেন ওকিনাওয়ার বাসিন্দারা। সেকারণেই তাঁরা এত দীর্ঘায়ু। কিন্তু আনাদের এখনকার লাইফস্টাইল তো উদ্দাম। মাংস, মদ আর পার্টি ছাড়া একনকার প্রজন্ম জীবনটাকে মনে করে জোলো। ওকিনাওয়ার জোলো খাদ্য তালিকা কী মুখে রুচবে এখনকার ছেলেমেয়ে কিংবা বুড়োদের। তাই ওকিনাওয়া নিয়ে হইচই করার আগে নিজেদের প্রশ্ন করা দরকার, আমরা কি নীরোগ দেহে দীর্ঘ জীবন আদৌ কি চাই?

সম্প্রতি প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনলাইন আলোচনার আসর “টেটে-এ-টি”তে জাপানি লেখক হেক্টর গার্সিয়া তাঁর তথ্যসমৃদ্ধ বই ‘ইকিগাই’ নিয়ে নানা বিষয় তুলে ধরেন।

সুস্থ জীবনের গোপন রহস্য কী, তার ব্যাখ্যা রয়েছে এই বইটিতে। জাপানি লেখকের সঙ্গে আলোচনায় ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ তথা লেখক বিক্রম সম্পত।

গার্সিয়ার লেখা বই ‘ইকিগাই’ বিশ্বের ৫৭টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সর্বাধিক ভাষায় অনুদিত বই হিসেবে নয়া নজির গড়েছে ‘ইকিগাই’।

জাপানের শতায়ু মানুষেরর সুদীর্ঘ জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে ‘ইকিগাই’-এর পাতায় পাতায়। গার্সিয়া জাপানের খাদ্যাভ্যাস ‘হারা হাচি ব্যু’-এর উল্লেখ করেন।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img