হোমলাইফস্টাইলনবাব আমল থেকে একালের কলকাতায় বিরিয়ানির জয়যাত্রা

নবাব আমল থেকে একালের কলকাতায় বিরিয়ানির জয়যাত্রা

নবাব আমল থেকে একালের কলকাতায় বিরিয়ানির জয়যাত্রা

রিমা কয়াল: আজকাল বাংলার পথঘাটে বিরিয়ানির রমরমা চোখে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় এবং দক্ষিণ এশীয়দের অতি প্রিয় খাবারগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই বিরিয়ানি। ভারত তো বটেই, ইরাক, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশে এই খাবারের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।

নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ১৮৫৮ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার পর কলকাতায় চালু হয় ‘কলকাতা বিরিয়ানি’। নবাবের বেগমদের হাতে তৈরি এই বিরিয়ানিতেই প্রথম দেখা মিলেছিল ডিম ও আলুর। খরচ বাঁচানোর জন্য মাংসের পরিমাণ কমিয়ে এই বিরিয়ানিতে যোগ করা হয়েছিল আলু ও ডিম। এছাড়াও বিরিয়ানিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল মিঠে আতর।

আওয়াধি বিরিয়ানি এবং কলকাতার বিরিয়ানির মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হল আলু। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়,  যে সব উপকরণ দিয়ে বিরিয়ানি বানানো হয়েছিল, সেটির স্বাদ রেস্টুরেন্টের  বিরিয়ানির চেয়ে পুরোপুরি আলাদা।

কলকাতার বিরিয়ানিতে মাংসের সঙ্গে কেওড়া জল, মিঠে আতর, ঘি, গরম মশলা,  মাখন, নরম আলু (বাঙালি বিরিয়ানি রেসিপিতে অবশ্যই) ব্যবহার করা হয়, যা এর স্বাদকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়।

বিরিয়ানি একটি উর্দু শব্দ, যা ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি ভাষায় বিরিঞ্জ অর্থ চাল বা ভাত। অন্যমতে, ফারসি শব্দ বিরিয়ান থেকে এসেছে, যার অর্থ রোস্ট বা ভেজে নেওয়া।

প্রাচীন পারস্যের খুবই জনপ্রিয় একটি পদ ছিল এই ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’। প্রাচীনকালে পারস্য থেকেই ভারতে আসত দুর্লভ আতর ও অন্যান্য গন্ধদ্রব্য। ঠিক এভাবেই পারস্যের ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল পারস্যের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’। নাম হয়েছিল ‘বিরিয়ানি'(Biryani)।

কেউ কেউ বলেন, চতুর্দশ শতকের মহাপরাক্রমশালী মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লঙের (Timur Lang) কথা। সিরিয়া থেকে চিনের কাশগড় পর্যন্ত ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি। পারস্যের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ ছিল নাকি তাঁর মনপসন্দ ডিশ। এবং তৈমুরের সেনাদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল বিরিয়ানি (Biryani)। কিন্তু সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য মতবাদটি জড়িয়ে আছে মুঘল রাজত্বের সঙ্গে।

ভারতে আসার পর, একমাত্র মুঘল সম্রাটদের খাবার টেবিলেই শোভা পেত বাষ্প ওঠা সুরভিত বিরিয়ানি। কিন্তু পরবর্তীকালে একটি অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে বিরিয়ানি হয়ে গিয়েছিল আমজনতার। একবার সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে রণক্ষেত্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহল (Mumtaz Mahal)। রণক্ষেত্রে গিয়ে মুঘল সম্রাটের সৈন্যদের দেখে আঁতকে উঠেছিলেন মমতাজ।

দিগ্বিজয়ী সম্রাটের সৈন্যদের এ কী অবস্থা! এই জীর্ণ শীর্ণ চেহারার সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ জেতার আশা করছেন সম্রাট শাহজাহান! পত্রপাঠ মুঘল সেনাদের জন্য পুষ্টিকর বিরিয়ানি রান্নার আদেশ দিয়েছিলেন মমতাজ। সেই প্রথম বিরিয়ানির স্বর্গীয় স্বাদ পেয়েছিল সাধারণ সৈন্যরা। এর পর থেকে মমতাজের আদেশে নিয়মিত বিরিয়ানি রাঁধা হতে লাগল মুঘল সৈন্যদের জন্য। প্রথমে এই মুঘল সৈন্য, পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন নবাব ও নিজামদের হাত ধরে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল বিরিয়ানি।

আজ ভারতীয়দের রসনা তৃপ্ত করে বম্বে বিরিয়ানি, কল্যাণী বিরিয়ানি, দিন্দিগাল বিরিয়ানি, অম্বর বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, হায়দরাবাদী বিরিয়ানি, তেহারি বিরিয়ারি, থালাইসেরি বিরিয়ানিসহ আরও কত বিরিয়ানি। খোদ ইরানেও বুঝি এত রকমের ‘বিরিঞ্জ  বিরিয়ান’ পাওয়া যায় না। কারণ ভারতবাসীদের মতো বিরিয়ানি নিয়ে এত গবেষণা করেনি ইরানও। ইরানের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ পূর্বসুরী হয়েও, নিজের অজান্তেই হেরে গিয়েছে ভারতের বিরিয়ানির কাছে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img