হোমভ্রমণবনভিলা গ্রামে লেখক সুব্রত সরকারের অন্যভুবন

বনভিলা গ্রামে লেখক সুব্রত সরকারের অন্যভুবন

বনভিলা গ্রামে লেখক সুব্রত সরকারের অন্যভুবন

নিজস্ব প্রতিনিধি: তাঁর নাম সুব্রত সরকার। থাকেন শহর কলকাতায়। তরুণ বয়স থেকেই শব্দ জুড়ে জুড়ে গল্প রচনা করাই তাঁর অন্যতম ভালবাসা আর অভ্যেস। ব্যক্তিগত পেশার জীবন অন্য কিছু, অন্যরকম।

কিন্তু গল্প রচনা করার সৃষ্টিশীলতা থেকেই তাঁর কল্পনা পাখা মেলে ছুটে যায় বহুদূর। স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন রচনা করতে ভালবাসেন। তারপর নিজের স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে ছুঁয়ে দেখার এক তীব্র বাসনায় প্রতিমুহূর্ত ছটফট করেন। আর সেটা করেন বলেই সুব্রত গড়ে দিতে পারেন সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষের জন্য এক ‘অন্যভুবন’।

২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি এই ভুবনের মাঝেই পা রেখেছিল ‘অন্যভুবন’।
কিন্তু অবস্থান কোথায়? সুব্রত নিজের কলমে লিখেছেন– “শান্তিনিকেতন-বোলপুর থেকে মাত্র ১০ কিমি দূরে রামনগর – বনভিলা গ্রাম। গ্রাম শেষ হলেই ইলামবাজারের সবুজ জঙ্গল। রামনগর গ্রামের শেষ প্রান্তে, আদিগন্ত ধূ ধূ সবুজের সমারোহের মাঝে ‘অন্যভুবন’ বড় আলোময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” কিন্তু কি হয় সেখানে? কোন প্রয়োজনেই বা তা গড়ে তোলা?
আসলে কলমের ছোঁয়ায় সাহিত্য সৃষ্টিতে যার আনন্দ, তিনি তো কিছু না পাওয়া মানুষের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে চাইবেন। আর সেই চাওয়া থেকেই তিনি শহর কলকাতা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে পিছিয়ে থাকা এলাকার প্রান্তিক স্তরের মানুষের নতুন প্রজন্মকে আলো দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর সেই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন আর এক দল স্বপ্ন দেখা তরুণ- তরুণী। যারা নিজেদের কাজে সমান আন্তরিক এবং সৎ ।
‘অন্যভুবন’- এর মাঝেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘ সবুজ পাঠ মুক্ত বিদ্যালয়’। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের নিয়মিত সহায়ক শিক্ষাদান করা এই কর্মকান্ডের অন্যতম উদ্দেশ্য। এটি কোনো প্রচলিত শিক্ষা কেন্দ্র নয়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এই শিক্ষাকেন্দ্র আসলে সহায়ক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই গড়ে উঠেছে। সপ্তাহে একদিন করে সেখানে আঁকা এবং যোগ শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আঁকার শিক্ষক বাপ্পা আঁকুড়ে। যোগ শেখান পরিতোষ দাঁ। শুধু শিক্ষকরাই নন। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার গুরুদায়িত্বে রয়েছেন চার দিদিমণি। এঁরা হলেন তুলসী মাড্ডি, শ্যামলী দাস, অপর্ণা ভট্টাচার্য এবং লক্ষ্মী কিস্কু। কিন্তু সুব্রত সরকারের ‘অন্যভুবন’-এর পরিচালনায় সহযোগিতার শক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আরো কিছু মানুষ। তাঁদের মধ্যে আছেন অনুপম হাজরা, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস, সুমন হেমব্রম, শুভেন্দু বর, শিবু দাস এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় টোটো চালক বঙ্কিম রায়। এই টিম নিয়েই সুন্দরভাবে গুছিয়ে এগোচ্ছেন সুব্রতবাবু। শুরু করেছিলেন মাত্র ১৩টি ছেলে- মেয়েকে নিয়ে। এখন তাঁর অন্য ভুবনে জীবন গড়ে তোলার প্রাথমিক শিক্ষাটুকু অর্জন করছে ৪৫টি ছেলে- মেয়ে।
২০১৮ সালের শুরুর সেদিনে হাজির হয়েছিলেন

বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক প্রাবন্ধিক রবীন পাল এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক- প্রাবন্ধিক স্বপন কুমার ঘোষ। দুই গুণীজনের শুভেচ্ছা মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছে অন্যভুবন।


যে ছোট ছোট ছেলে- মেয়েগুলো এখানে সহায়ক শিক্ষা নিতে আসে তাদের অন্য প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রেও সমান তৎপর ‘অন্যভুবন’। বই খাতা থেকে শুরু করে জলের বোতল- ছাতা- জামা- জুতো এমনকি শীতের সোয়েটার পর্যন্ত বিনামূল্যে ওদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন লেখাপড়া শেষে টিফিনের ব্যবস্থাও করা হয়। স্কুল শুরুর আগে এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা যে প্রার্থনা সংগীত গায়, তার রচনাকার সুব্রত সরকার নিজেই। “আমরা পড়ব, আমরা শিখব, আমরা গাইব গান/আমরা খেলব, রক্ষা করবো, আমাদের বাগান”–গানে প্রতিদিনই মুখরিত হয়ে ওঠে অন্যভুবন-এর প্রাঙ্গণ।


এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। রুটিরুজি হারিয়ে ঘরবন্দি অবস্থা দেশের অসংখ্য মানুষের। রামনগর- বনভিলা গ্রাম এসবের বাইরে নয়। মূলত আদিবাসী শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষের বসবাস এখানে। স্বাভাবিকভাবেই এই মুহূর্তে সব থেকে বড় কাজ বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। অনুভূতিপ্রবণ সৃষ্টিশীল সুব্রত সরকার তাই এই বিপন্ন সময়ে অন্য ভূমিকায়। মানুষ মানুষের জন্য — এই ব্রত নিয়ে তিনি এখন যে পরিবারগুলি থেকে ছেলেমেয়েরা ‘সবুজ পাঠ মুক্ত বিদ্যালয়’ -এ পড়তে আসে সেই পরিবারগুলির সকলের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আন্তরিক প্রয়াস চালাচ্ছেন। বন্ধু- শুভানুধ্যায়ীদের বাড়ানো হাতের সহযোগিতাকে সঙ্গে নিয়ে ওই পরিবারগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছেন চাল, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, তেল, সয়াবিন, মুড়ি , বিস্কুট, ছাতু, সাবান ইত্যাদি সামগ্রী।
কিন্তু যে মানুষ অন্য মানুষের বিপন্নতাকে অনুভব করতে পারেন, তাঁরা চেষ্টা করেন নিজেদের সহযোগিতার হাত যতদূর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়ার । তাই সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলির বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে রামনগর গ্রামের পড়শী এলাকা কামারপাড়া, গোপালনগর, শ্রীচন্দ্রপুরের দু’শোর বেশি পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে ‘অন্যভুবন’। । চেষ্টা করছে আগামী দিনগুলোতেও পাশে দাঁড়াবার।


এভাবেই সর্ব অর্থে এক নতুন ধরনের ‘অন্যভুবন’ গড়ে তোলার অপ্রতিরোধ্য লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন সুব্রত সরকার।
মানুষের ব্যক্তি জীবনে অনেক ওঠানামা থাকে। হাসি- কান্না ব্যথা- বেদনাময় মানুষের জীবন। তবু তারই মধ্যে এগিয়ে যেতে হয় নিজের লক্ষ্যে। থেমে থাকার সুযোগ হয় না। তাই সুব্রত এগোচ্ছেন। আশা করছেন একদিন করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক পিছু হঠবে। লোকডাউনেই আসবে পরিপূর্ণ লকডাউন।নতুন সূর্য উঠবে। আপাতত বন্ধ থাকা অন্য ভুবনের প্রাঙ্গণ আবার একদিন মুখরিত হবে ৪৫টি শিশুর কলরবে।

যোগাযোগ – অন্যভুবন। ফোন নম্বর – ৯৮৩১০৫১৭২২

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img