বর্ণালী জানা
একুশ দিনের লকডাউন। অবরুদ্ধ নগরী। সারাদিন ঘরে বসে আসছে অস্থিরতা, অ্যাংজাইটি, কখনও কখনও ডিপ্রেশন। অস্থিরতা থেকে মনটা খিঁটখিঁটে হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা নেই, শপিং মলে উইন্ডোশিপং নেই, ডাইনআউট নেই…কী করে কাটবে সময়? সারাদিন মোবাইলটা নিয়ে শুধু খুঁটখাট। মনের ওপর এই চাপ নানা ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এক রিপোর্ট বলছে এই লকডাউনের সময় ফ্রান্সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনা নাকি তিরিশ শতাংশ বেড়ে গেছে। মানুষের মনে ঢুকছে ভয়…বাড়ছে প্যানিক অ্যাটাক। ঐ দিল্লির ঐ ছেলেটির কথাই ধরুন। করোনা হয়েছে এই ভয়েই সে হাসপাতালের সাত তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি দেখে অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে বসলেন জার্মানির এক মন্ত্রী
এই রোগের কোনও দাওয়াই নেই। তাই সবাই বলছেন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং , ভিড়-ভাট্টা এড়িয়ে চলার কথা। কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-কথাটাতে ঘোর আপত্তি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট গার্গী দাশগুপ্তের। তাঁর কথায়,‘ব্যাপারটা আসলে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ফেসবুক আছে, টুইটার আছে, ইন্সটাগ্রাম আছে…ডিজিটাল মোডে সোশ্যালাইজিং-এর কোনও খামতি পড়ছে না’।
কিন্তু ঐ যে ঘরের বাইরে বেরোতে পারছি না ওটাই যত অসন্তোষের কারণ। আসলে মানুষ তো এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না লকডাউন না করার কারণেই ইতালি আজ মৃত্যুপুরী। ‘মানুষ ভাবছে জোর করে তাদের ওপর ব্যাপারটা চাপিয়ে দেওয়া হল, আর এই কারণেই যত ইরিটেশন’…বললেন মনোবিদ সপ্তদীপা সাহা।
এই ইরিটেশনের জন্যই আইসোলেশনের নিয়ম ভেঙে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। হাসপাতালের কোয়ারিন্টাইন থেকে লুকিয়ে পালাচ্ছে। এ যেন চোর পুলিশ খেলা।
এই আইসোলেশন বা কোয়ারিন্টাইন কিন্তু আজকের কথা নয়। যখনই মানব সভ্যতার বুকে এমন মহামারী আছড়ে পড়েছে তখনই কোয়ারিন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চতুর্দশ শতকে প্লেগ মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে ইতালিতে প্রথম কোয়ারিন্টাইন চালু করা হয়েছিল। রোগের কবলে পড়া এলাকাগুলি থেকে যাতে সংক্রমন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ভেনিসে আসা জাহাজগুলিকে বন্দরেই চল্লিশ দিন নোঙর করিয়ে রাখা হত। কোয়ারিন্টাইন শব্দটাও এসেছে ইতালীয় Quaranta giorni’ থেকে যার অর্থ চল্লিশ দিন। অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস! স্বপ্নের দেশ ভেনিসই আজ শ্মশান!
করোনার কারণে মানসিক সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে—এ বিষয়ে মনোবিদরা একমত। কাল কী হবে, চাকরি চলে যাবে কিনা, ব্যাংকের ইএমআই-এর কী হবে, বাড়ি ভাড়ার কী হবে—এই ভেবেই মানুষ আতান্তরে। এমনিতেই এদেশের ৯ কোটি মানুষ নানান রকম মানসিক সমস্যায় ভোগেন, যা কিনা দেশের জনসংখ্যার মোট ৭.৫ শতাংশ। এই তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। ২০১৫-১৬ সালের চালানো নিমহ্যানস-এর এক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, দেশের প্রায় ১৫ কোটি মানুষের মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন। আর এই পরিস্থিতিতে তো আরো মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাদের সাহায্য করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মনোবিদ কি আছে আমাদের দেশে?
মনোবিদ পম্পা মৈত্র চক্রবর্তী জানালেন… ‘এমন অনেক পেশেন্ট এখন পাচ্ছি, যারা আগে ডিপ্রেশন থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছিলেন তাদের আবার অসুখটা রিল্যাপ্স করছে’। আবার যারা মাদক সেবন ছেড়ে দিয়েছিলেন, তারাও এই বন্দি হয়ে থাকার হতাশা কাটাতে আবার নেশা শুরু করেছে—এমনটাই পম্পাদেবীর অভিজ্ঞতা। অ্যালার্জি বা ঋতু পরিবর্তনের কারণে সামান্য সর্দি কাশি হলেও মানুষের প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে… COVID-19 হল না তো…মনোবিদ অর্পিতা গুহর কাছে এই সমস্যা নিয়ে অনেকে এসেছেন।
‘আমাদের মানসিক সমস্যাগুলো আমরা অনেকটাই নিজে সারিয়ে ফেলতে পারি। আসলে আমাদের জীবন এত বহির্মুখী হয়ে গেছে যে, বাইরে থেকে কোনও একটা উত্তেজনা না পেলেই আমরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি’, বললেন গার্গীদেবী। এই ঘরবন্দি হয়ে থাকার সময় আমরা নিজেই নিজেদের সঙ্গে ‘সোশ্যালাইজ’ করতে পারি। নিজেদের ভেতরটা তলিয়ে দেখতে পারি। নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে যোগযোগ গড়ে তুলতে পারি। কবিগুরু তো বলেই গেছেন… ‘অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে’। অন্তরাত্মার সঙ্গে একবার যোগাযোগ গড়ে তোলা গেলে তখন আর বাইরের কোনও উত্তেজনা, কোনও ইনস্পিরেশনের দরকার পড়বে না, এমনটাই মত গার্গী দেবীর।
সময়টাকে ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগান। এত দিন করছি, করব ভেবে যে কাজগুলো করা হয়নি সেগুলো এবেলা সেরে ফেলুন। বই পড়ুন, গান শুনুন, ঘর গোছান, বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান। বয়স্ক বাবা-মাকে সময় দিন। বাচ্চাদের নতুন নতুন হবি গড়ে তুলুন, তাদের সঙ্গে ইনডোর গেমস খেলুন, তাদের কাছে নিজেদের ছোটবেলাকার গল্প বলুন। কুড়ি বছর আগে আপনাদের জীবনটা কেমন ছিল, তারা তা জানতে পারবে। হালকা ব্যায়াম করুন। বাড়ির তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার খান… ‘বিশেষ কড়ে ডাঁটা, পেয়ারা যাতে মুখের এক্সারসাইজ হয়। তাতে উদ্বেগ অনেক কমে’…জানালেন পম্পাদেবী।
আর অবশ্যই ‘বি পজিটিভ’। নিজেদের চারপাশে আপনার পজিটিভিটি ছড়িয়ে দিন। এই রোগ কতটা মারাত্মক সেটা নিয়ে মাথা খারাপ করার চেয়ে কত রুগি সুস্থ হয়ে উঠছেন, সেটা ভেবে ভালো থাকার চেষ্টা করুন। সারাক্ষণ মোবাইল ঘাঁটার অভ্যেস ছাড়ুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ভুয়ো খবর থাকে। তাতে মনের ওপর চাপ পড়তে পারে। একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য সূত্র থেকেই করোনা সংক্রান্ত খবর নিন। আর টিভির সামনেও সবসময় সেঁটে বসে থাকবেন না। দিনে দু-বার আপডেট নিন। ছোটখাটো এই ধরনের কিছু পদক্ষেপ নিলে আমরা ঠিক মনের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। বিশেষ করে বাড়িতে বয়স্ক যারা আছেন, তাঁদের একটু ভরসা দিন। খবরের কাগজে, টিভি-তে দেখে তারা সবসময়ই নিজেদের ভালনারেবল ভাবেন । এই বুঝি ‘আমাকে এই রোগ ধরল’। তাই খুব দরকার পড়লে মনোবিদের সাহায্য নিন—এই কঠিন মুহূর্তে এটাই গার্গী দেবীর পরামর্শ।