হোমপত্রপত্রিকাতালাচাবির তলার ছবি

তালাচাবির তলার ছবি

তালাচাবির তলার ছবি

দেবস্মিতা নাগ:স্টেশন পর্যন্ত পিছন পিছন এসেছিল ভুলুয়া।
বুধিয়া লছমি আর রানি যখন দেশে যায়, তখনই ভুলুয়া ওদের স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ট্রেনে ওঠা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। রানিও জানলা দিয়ে দেখার সুযোগ পেলে, ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ভুলুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টে।

আবার যখন বুধিয়া সুলতানপুর ইট ভাটায় ফিরে আসে, তখন ভুলুয়া রানিকে দেখে লেজ নেড়ে নেড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কত আদর দেখায়। দেশে গেলে এক মাস আর ভুলুয়ার সাথে দেখা হয় না। প্রতি বছর ছট পুজোয় বাড়ি যাওয়ার সময় রানির মনটা খারাপ হয়ে যায় ভুলুয়ার জন্যে।

ভুলুয়ার এখন ৪ বছর বয়স। গত ৪ বছর ধরে এরকমটাই হয়ে এসেছে। রানির এখন বয়েস 9 বছর। জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ভুলুয়াই ওর খেলার সঙ্গী। ছোটবেলায় ও ভুলুয়াকে পাহারা দিত। এখন লছমি আর বুধিয়া যখন ওকে ঘরে রেখে ইট ভাটায় যায়, তখন ভুলুয়াই ওকে পাহারা দেয়। মাঝে মাঝে রানি ইস্কুলে যায়।

ইস্কুলের মাস্টার মশাই খাতায় ওর নাম তুলে দিয়েছেন। বই ,জামা, জুতো ,ব্যাগ,বোতল,ছাতা সবই দিয়েছেন। ওখানে গেলে দুপুরে ভালো খাওয়াও যায়। কিন্তু তবু রানি রোজ স্কুলে যায় না। কারণ ও ভালো বাংলা বোঝে না। ওখানে সেই জন্য ওর ভালো বন্ধুও হয়নি। ভুলুয়াই ওর এক মাত্র বন্ধু। ইস্কুলে গেলে ইস্কুলের গেটের বাইরে ঠায় বসে থাকে ভুলুয়া পুরো সময়টা। সেই জন্যই তো ভুলুয়াকে রেখে দেশে যেতে খুব মন খারাপ করে রানির।

আজ সকালে উঠেই রানি শুনেছে, মা বাবা দুজনেই দেশে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে। জামা কাপড় গোচগাছ করছে। কিন্তু এখন তো ছটপুজো না। তাহলে কেন ওরা দেশে যাচ্ছে! জিজ্ঞেস করায় রানি জানতে পারে যে, তারা শুধু দেশে যাচ্ছে তাই নয়, হয় তো একেবারে চিরদিনের মতো দেশে যাচ্ছে আর ফিরবে না।

এতদিন রানি জানতো এই ভাটাই তার বাড়ি। এখানে ওর কয়েকজন বন্ধুও আছে। সবাই নাকি যার যার দেশে ফিরে যাবে। কে জানে, সবাই আবার আসবে কিনা, আবার খেলা হবে কিনা, আর ভুলুয়া? ওর কি হবে? ও তো কাঁদবে! কে ওকে খাওয়াবে? আর কি কোনওদিন দেখা হবেনা ওর সাথে! এসব ভেবে লুকিয়ে অনেক কেঁদেছে রানি। কিন্তু মা বাবাকে কিছু বলেনি। কারণ ও দেখেছে, ভাটায় তিন মাস ভালো কাজ হয়নি, মাঝে তো পুরোই বন্ধ ছিল,তার মধ্যে ভাটায় কয়েকজনের কি একটা অসুখ করেছে,সেই ভয়ে ওরা আরো দেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

রানি এখন বুঝতে শিখেছে। ও বুঝতে পারছে, এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে ওর যাচ্ছে, যেরকম আগে কখনো দেখেনি ও। এই ক’মাস ভালো করে খেতেও পায়নি ওরা। ইস্কুলও বন্ধ। সেখানে গেলে যে খাওয়া জুটবে সে আশাও নেই। ইস্কুলের চাল, ডাল আর আলু দিয়ে ওর টুকু চলে গেছে। কিন্তু মা বাবার আরও কিছু খরচ আছে। দেশেও টাকা পাঠাতে হয় বাবাকে। এ অবস্থায় বাবার চিন্তা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। তাই রানিরা আজ দেশের পথে রওনা দিয়েছে। সঙ্গে ভাটার আরও অনেক লোক। কিন্তু ওরা সবই ভাগলপুর যাবেনা,ওদের অন্য জায়গায় বাড়ি।

আজ খুব ভিড়। বুধিয়া ট্রেনে উঠে ভুলুয়াকে এক ঝলক একবারই দেখতে পেয়েছে। লেজ নেড়েছিল। রানির খুব ইচ্ছে ছিল, ভুলুয়াকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু ট্রেনে কুকুরকে উঠতে দেবে না। তাড়াতাড়ি জানলার কাছে গিয়ে ভুলুয়াকে শেষবার দেখার চেষ্টা করলো রানি…পারলো না। চোখের জল আর সামলাতে পারলো না রানি। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। এরপর অনেক ক্ষণ ওরা তিনজনেই চুপ চাপ ছিল। তারপর বুধিয়া বললো, “আবার সব চালু হলে এখানেই ফিরে আসবো,সেই পনের বছর বয়স থেকে আছি। মন বসে গেছে। দেশেও তো খেতিবাড়ি নেই,খাবো কি?”

শুনে আনন্দে নেচে উঠলো রানির মনটা। তার মানে আবার আগের মতো ও ভুলুয়ার সাথে একসাথে থাকতে পারবে! কি মজা!

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img