দেবস্মিতা নাগ
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (Acharya Prafulla Chandra Roy) কি কখনও এই ভাবে ভেবেছিলেন “আজি হতে শত বর্ষ পরে কে তুমি পান করিছ বসি আমার শরবত খানি”? হয়তো না। কিন্তু ঘটেছে এমনটাই। স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত বাংলার বরিশাল থেকে আগত নীহার রঞ্জন মজুমদারকে (Nihar Ranjan Majumder) একটি “ডাব শরবত”-এর ফর্মুলা বাতলে দিয়েছিলেন জগৎ বিখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যা আজ ১০০ বছর পরেও সগৌরবে মহানগরের তৃষ্ণা মিটিয়ে চলেছে।
শরবতটির (Sherbats) স্বাদ নিতে হল, যেতে হবে মধ্য কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের ১/১, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। সেখানে ১৯১৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছে “প্যারামাউন্ট” (Paramount)। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী নয়, প্যারামাউন্ট আজ নিজেই একটা ইতিহাস। আর সেই কারণেই খুব সহজেই “ইনট্যাক”-এর হেরিটেজ শিরোপা অর্জন করেছে এই দোকান।
প্যারামাউন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা নীহারবাবু নিজে অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। দোকানটির আদি নাম রেখেছিলেন “প্যারাডাইস”। প্যারাডাইসের পিছনে গোপন কক্ষে শরবত বিক্রির পাশাপাশি ছিল বিপ্লবী সতীন সেনের স্বদেশী কার্যালয়। চলতো বিপ্লবীদের আনাগোনা, ছকতেন তাঁদের গুপ্ত পরিকল্পনা। সেই সময়ের সমস্ত কথা নীহারবাবুর ডায়েরিতে মিলেছে। আসতেন বাঘা যতীন, পুলিন বিহারী দাস।
১৯৩৭-এ ব্রিটিশ (British) সরকারের বন্ধ করে দেওয়া প্যারাডাইস “প্যারামাউন্ট” নাম নিয়ে আবার আত্মপ্রকাশ করে। এর মেঝেতে মিশে রয়েছে সুভাষ চন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose), জগদীশ বসু (Jagadish Bose), মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসুর পায়ের ধুলো। এই দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। একসময় চলচ্চিত্র জগতে উজ্জ্বল তারকারা আলোকিত করতেন প্যারামাউন্টকে। এখানে আসতেন সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, বিকাশ রায়ের মত ব্যক্তিত্বরা। বিখ্যাত সাহিত্যিকদেরও কলমের গোড়ায় রসদ জুগিয়েছে এই দোকানের শরবত। আসতেন সমরেশ বসু, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, সৌমেন ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখেরা। সিদ্ধার্থ শংকর রায় থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কেউই নিজেদের এই শরবতের স্বাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেননি।
দোকানের অঙ্গসজ্জায় রয়েছে মার্বেলের টেবিল, কাঠের চেয়ার, হায়দরাবাদের নিজামের কাছ থেকে নিলামে কেনা দেওয়ালে ঝোলানো দুটি বিরাট হরিণের শৃঙ্গ যুক্ত মাথা। দেওয়ালে ঝোলানো আছে রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র,রামকৃষ্ণর ছবি। গোড়ায় শরবতের দাম ছিল ৪ আনা। আজ তা বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। শরবতের সর্বোচ্চ মূল্য ১২০টাকা।বিখ্যাত ডাব শরবতের মূল্য মাত্র ৫০টাকা।
শরবত তৈরির গুপ্ত প্রণালী বংশ পরম্পরায় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাইরের কাউকে বলা হয় না। এখানকার বেশিরভাগ খদ্দের বরাবরই ছাত্রছাত্রী। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই শরবতের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন নাম, নতুন নতুন মিশ্রণ। নয়া প্রজন্মকে খুশি করতে এসেছে প্যাশন ফ্রুট শরবত, কেশর মালাই শরবত। পাশাপাশি সাবেক কালের উজ্জ্বল সবুজ রঙের কাঁচা আমের শরবতও রয়েছে।
বিজ্ঞাপনের ইঁদুর দৌড়ে কোনওদিনই প্যারামাউন্ট এক পয়সাও খরচ করেনি। তারা খাদ্যগুনে বিশ্বাস করে। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়ের ইতিহাসকে বুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে প্যারামাউন্ট।