ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম মাতৃভাষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। মাতৃভাষা চর্চার এত বড় উদ্যোগ নিলেন তিনি, অথচ বাংলার শিক্ষিত সমাজ তা ভালোভাবে নিল না। চারদিক থেকে প্রবল ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার হতে থাকলেন। এই উদ্যোগকে স্বাগত-সমর্থন তো দূরের কথা, যাঁরা বাংলা নিয়ে পড়ছেন, তাঁদের যত্রতত্র অপমান করতে লাগলেন। সমকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মনে করতেন, ভাষা হিসাবে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ইংরেজি। বাংলায় যাঁরা প্রবন্ধ ও সাহিত্য লেখেন, সভা-সমিতিতে ভাষণ দেন, বিজ্ঞান চর্চা করেন, তাঁদের মেধা ও বোধ একেবারে তলানিতে। এরকম আটপৌরে ভাষা এম.এ ক্লাসে পড়বে কী! আজও কিন্তু অবস্থার খুব একটা হেরফের ঘটেনি।
বাংলার বাঘ আশুতোষের কানে গেল বাংলা ভাষা নিয়ে ছিছিক্কার করছেন বুদ্ধিজীবীরা। অনেক লড়াই করে এ কাজ তিনি শুরু করিয়েছিলেন। ভালো ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে অস্বীকার করায় খুব দুঃখ পেলেন তিনি। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। “আপনি আচরি ধর্ম/পরেরে শেখাও” আপ্তবাক্যটিকে বাস্তবে রূপ দিলেন। তাঁর মধ্যম পুত্র যিনি আই.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্র রৌপ্যপদক পেয়েছেন, যিনি বি.এ. ইংরেজি অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র স্বর্ণপদক লাভ করেছেন, তাঁকেই পাঠালেন বাংলায় এম. এ পড়াতে। চারদিকে তখন মহা শোরগোল পড়ে গেল।
পিতার ইচ্ছেকে সম্মান দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ ইংরেজি নিয়ে এম.এ পড়তে গেলেন না, ভর্তি হলেন বাংলায় এম.এ পড়তে। ইংরেজি তাড়িয়ে বাংলা সওয়াল করা রাজনীতিবিদেদের মতো ছিলেন না আশুতোষ। অন্যকে বলবেন বাংলা মাধ্যমে পড়ো, আর নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করিয়ে সুখনিদ্রা দেবেন, এরকম ধাতের মানুষ ছিলেন না আশুতোষ। আর এজন্যই ‘বাংলার বাঘ’-এর পুত্র হয়ে উঠলেন ‘ভারতকেশরী’।
১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষায় এম.এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হলেন শ্যামাপ্রসাদ। পরীক্ষার অঙ্গ হিসাবে মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করলেন “The social plays of Girish Chandra”, অর্থাৎ নাটক নিয়ে কাজ। এম.এ পাশের পর ল’ পাশও করেছেন তিনি। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতেও গিয়েছিলেন। এমন একজন কৃতি ছাত্র তাঁর পিতার আদেশে এবং যজ্ঞে নিজেকে একান্তে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলায় এম.এ. পড়াকালীন বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পৌত্রী সুধাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল (১৬ ই এপ্রিল, ১৯২২)। এই শ্যামাপ্রসাদকে দেখা যায় বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়।
স্যার আশুতোষ মুখার্জির উৎসাহ অনুপ্রেরণা তো ছিলই, শ্যামাপ্রসাদ প্রশাসনে এসে আরও সক্রিয় হয়ে উঠলেন লোকসংস্কৃতি সংগ্রহের কাজে, বাংলায় লোকসংস্কৃতি চর্চায় এলো নবদিগন্ত। ড. দীনেশচন্দ্র সেন লোকসাহিত্যের হারামণি সংগ্রহে আশুতোষকে সাথে পেয়েছিলেন। আশুতোষের মৃত্যুর পর এই প্রকল্প প্রায় অনাথ হয়ে গেল। ভাঁটার মরশুমে এগিয়ে এলেন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ। তিনি নিজে বাংলার ছাত্র, তাই জানতেন গীতিকা সংগ্রহ ও গবেষণার কাজটি কতটা মূল্যবান। তা ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অনন্য উত্তরাধিকার।
নিজে ‘Bengali Ballads Committee’-র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেন, দীনেশবাবুর কাজ যথোচিতভাবে সম্পন্ন করতে অগ্রসর হলেন। সরকারি কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, এই কাজের গুরুত্ব কতটা, তা হারিয়ে গেলে সাহিত্যের ইতিহাসে কী ক্ষতি! এতে কাজ হল; গীতিকা সংগ্রাহক-গবেষকদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা গেল, সংগ্রহের কাজ এগোলো জোর গতিতে, মুদ্রিত হতে লাগল ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকার টেক্সট।
শ্যামাপ্রসাদকে তাঁর উপাচার্যকালীন সময়ে (৮ অগাস্ট, ১৯৩৪ — ৭ অগাস্ট, ১৯৩৮) বাংলা ভাষার জন্য আরও প্রশাসনিক কাজ করেছিলেন। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন তৈরির পৌরোহিত্য করলেন শ্যামাপ্রসাদ। তিনিই সেই পুরোহিত, যিনি মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে ম্যাট্রিকুলেশন স্তরে পঠনপাঠন ও পরীক্ষা দেবার বন্দোবস্ত করালেন। বাংলা বানান পদ্ধতি নির্ধারণে এগিয়ে এলেন; বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা পরিভাষা রচনা ও সংকলনের নেতৃত্ব দিলেন, বাংলা ভাষায় পিএইচ.ডি. গবেষণা পত্র জমা দেওয়ার অনুমতি দিলেন।
তিনিই সেই সাহসী মানুষ যিনি বাংলা ভাষায় সমাবর্তন ভাষণ দেবার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। সমাবর্তন উৎসবে জাতীয় পরিচ্ছদে গমনের কৃতিত্বও তাঁর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে কুচকাওয়াজে বাংলা ভাষায় রচিত জাতীয় সঙ্গীত গীত হল; ছাত্রদের পরিধানে ধুতি-পাঞ্জাবী, তাঁরা গাইছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত — “চলো যাই চলো যাই চলো/যাই চলো যাই/চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে,/চলো দুর্জেয় প্রাণের আনন্দে,/চলো মুক্তিপথে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, বাংলা ভাষার মর্যাদাবৃদ্ধির কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতেন না প্রশাসক শ্যামাপ্রসাদ। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে বাংলা ভাষায় অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করলেন “……আপনাদের জ্ঞান-সাধনা অক্ষয় ও জয়যুক্ত হউক, ইহাই আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করি…..।” লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানেও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে বাংলায় অভিনন্দন বার্তা লিখলেন (১৫ ই জুন, ১৯৩৬), “….লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়ঃক্রম শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ায় এই প্রাচ্যভূমি হইতে আমরা আনন্দ প্রকাশ করিতেছি, এবং আমাদের আন্তরিক কামনা জানাইতেছি যে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় জয়যুক্ত হউক, তাহার কর্মক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করুক, এবং তাহার শিক্ষা ও জ্ঞান-প্রচারের আদর্শ কালজয়ী হউক…..।” যদিও উভয়ক্ষেত্রে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি তর্জমা ছাপানো হয়েছিল। বাঙালি হিসাবে এটা গর্বের যে, নাগপুর (১৯৩৬), বোম্বাই (১৯৩৭), পাটনা (১৯৩৭), গুরুকূল (১৯৪৩) বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ দানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে আমন্ত্রণ বাঙালিদের সম্মান বাড়িয়েছে।
বাংলা ভাষার প্রভাব খর্ব করতে মুসলিম লীগ ‘উর্দু একাডেমি’ গড়ে তুলে বাংলাভাষা বিরোধী প্রচারাভিযান শুরু করেছিল, তার সঙ্গে ধর্মীয় আবেগ মিশিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা জাগরণের কৌশল নিল তারা। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রচার চালানো হল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ইসলামবিরোধী, সহি মুসলমান তিনিই হবেন, যিনি উর্দু ভাষা ব্যবহার করবেন। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছিলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বহু সুসন্তান সমগ্র ভারতে এবং কয়েকজন সমগ্র বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। বিংশ শতাব্দীতে যাঁহারা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে বিশ্বজগতে তো দূরের কথা সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি বা মর্যাদা লাভ করিয়াছে এরূপ বাঙালি নাই বলিলেই চলে। ইহার এক ব্যতিক্রম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।”
যে সমস্ত অধ্যাপক-শিক্ষক-গবেষক-ছাত্রেরা আজ বাংলা নিয়ে পড়ছেন, তাঁরা এখন ভুলে গেছেন, শ্যামাপ্রসাদ ও আশুতোষ মুখার্জির কৃতিত্ব। যে বাংলা বিষয়ে পড়াটা রঙ্গব্যঙ্গের পর্যায়ে ফেলেছিলেন বাংলার বুদ্ধিজীবিদের একাংশ, তাঁরা আজও সমানভাবেই সক্রিয়। অনেক বাঙালি বিদ্বজ্জনের ‘বাংলাভাষাটা ঠিক আসে না’, তাঁদের ঔদ্ধত্য ক্ষমাহীন। বিজ্ঞানী হলে তো কথাই নেই, তাঁদের অধিকাংশই ভাবেন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে কিছুতেই প্রকাশ করা যায় না, বাংলায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখা একটা অত্যন্ত অযোগ্যতার ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানাচার্য ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, যারা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সূত্রকে প্রকাশ করতে পারেন না, তারা হয় বিজ্ঞান জানেন না, নতুবা বাংলা জানেন না।
এত সমৃদ্ধ যে ভাষা, এত রকমারি সাহিত্য লেখা হয়েছে যে ভাষায়, এত দর্শন প্রকাশিত হয়েছে যে মাধ্যমে, তার দ্বারা বিজ্ঞান চর্চা কেন হবে না? যদি বাংলার বিজ্ঞানী সমাজ এখনও এগিয়ে না আসেন, তবে বাংলা ভাষার গবেষক-শিক্ষকদের সমবেত উদ্যোগ এই কাজ করতে নেতৃত্ব দিন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা এগিয়ে আসুন। সমস্ত বিদ্যাশৃঙ্খলার জন্য কার্যকরী পরিভাষা, শব্দ-বন্ধ, বাক্যগঠনের রূপরেখা স্থির হোক। বিজ্ঞানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে বাংলার একটি কোর্স থাকুক, যাতে বিশিষ্ট মানুষের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলি স্থান পেতে পারে। কর্মশালার আয়োজন হোক দিকে দিকে, বাংলা-বিদ্যাবিদেরা দেখিয়ে দিন তাদের পারদর্শিতা।
‘বাংলাভাষায় বিদ্যাচর্চা সম্ভব নয়’ তা যতক্ষণ পর্যন্ত জগদ্দল পাথরের মতো বাঙালিদের মগজে গেঁথে থাকবে, ততদিন বাংলাভাষার অধ্যাপক-গবেষকেরা ‘#বেঙলার #মেস্টার’ হয়েই ক্ষুদ্র, নগণ্য হয়ে রয়ে যাবেন। শ্যামাপ্রসাদের চিন্তা-চেতনা যদি কারো মনে একটুও দাগ কেটে থাকে, তাহলে এই প্রচেষ্টার অবিলম্বে বাস্তবায়ন হোক। বাংলাদেশের কম মেধার বিজ্ঞানীদের চাইতে পশ্চিমবঙ্গ ও বিশ্বের নানান স্থানে অধিষ্ঠিত বাঙালি প্রবুদ্ধমানুষের মেধা আরও ক্ষুরধার। বাংলায় যাবতীয় গবেষণাপত্র লেখার কাজ তাই শুরু হোক, প্রতিটি বিষয়ে প্রকাশিত হোক বিশ্বমানের গবেষণা পত্রিকা। ইন্টারনেট ঘাঁটলে যে অনাবশ্যক বিদেশি-মিশ্রিত বাংলায় অসংখ্য লেখাপত্তর পাওয়া যায়, দু’টি পংক্তি পড়ার পর সুখপাঠ্য মনে হয় না, তাকে ছাপিয়ে বিশুদ্ধ বাংলায় ভোরের পাখি গেয়ে উঠুক।
বাংলার পন্ডিত ব্যক্তিরা প্রমাণ করে দিন, বাংলা ভাষায় এত দীনতা নেই, যে তা অপ্রকাশ্য। কোনো অজুহাতই শুনবেন না, কাজ করে দেখিয়ে দিন, মাত্র দশ বছরে আরদ্ধ কাজের যথাযোগ্য বোধন হয়ে যাবে। মাতৃভাষাকে যিনি মর্যাদা দিতে পারেন না; তিনি একজন ব্রততী, তিনি একজন আরোহী, তার লতিয়ে ওঠার মাচা করে দেওয়া দরকার। এত বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তার সঙ্গে তালমেলাতে পারিনি আমরা। বাঙালি হিসাবে এ দুঃখ কোথায় রাখি! আমাদের একজন রবীন্দ্রনাথ থাকতেও পারিনি।