জানেন কি, গাছও হাঁটতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে এক বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যারা জায়গা বদল করতে পারে। এই কারণে ওই গাছটিকে বলা হয় ‘ওয়াকিং পাম’ (Walking Palm)। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই উদ্ভিদ প্রজাতির নাম হল ‘সক্রেটিয়া এক্সোরিজা’ বা ‘ক্যাশাপোনা’।
ইকুয়েডরের (Ecuador) রাজধানী কুইটো (Quito) থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে সুমাকো বায়োস্ফিয়ারেই রয়েছে এই ক্যাশাপোনা পাম গাছ। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এই সংরক্ষিত অরণ্যে গবেষণা করতে গিয়ে এই উদ্ভিদের খোঁজ পান স্লোভাক ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেসের গবেষক পিটার ভ্রানস্কি। তিনি দাবি করেছিলেন, এই নতুন উদ্ভিদটি স্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম। যদিও তাঁর এই দাবিকে সেসময় মেনে নেননি বিজ্ঞানীরা।
১৯৮০-র দশকে ইকুয়েডরের এই আমাজনিয়ান অরণ্যে আবার অভিযানে জীববিজ্ঞানী জন এইচ বোদলে। দীর্ঘদিন ওই অরণ্যে থেকে তিনি গাছটির গতিবিধি এবং জীবনপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেন। এর পরই চলমান উদ্ভিদের অস্তিত্বের কথা প্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে মেনে নেওয়া হয়।
কিন্তু কীভাবে জায়গা বদল করে এই উদ্ভিদ? প্রায় ১৮-২০ মিটার বা ৬০-৭০ ফুট লম্বা হতে এই উদ্ভিদকে দেখতে অনেকটা সুন্দরবন এলাকার সুন্দরী জাতীয় ম্যানগ্রোভ গাছের মতো। সুন্দরী ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হওয়ায় যেমন শ্বাসমূল দেখা যায় তাদের দেহে, তেমনই দেখা যায় ঠেসমূলের উপস্থিতিও। ‘ওয়াকিং পাম’-এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম।
ইকুয়েডরের ওই অঞ্চলের মাটি বেশ আলগা এবং জলধারণ ক্ষমতাও খুব কম। সেইসঙ্গে গভীর জঙ্গলের কারণে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না। তাই ওই গাছ অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই ‘ওয়াকিং পাম’-এর শিকড়ের দৈর্ঘ্য অন্যান্য গাছের তুলনায় বড় হয়। দেখতে অনেকটা হাতির শুঁড়ের মতো।
পাশাপাশি অত্যন্ত দ্রুত নতুন নতুন ঠেসমূল তৈরি করে সক্ষম ‘ওয়াকিং পাম’। এর ফলে একদিকে যেমন এই উদ্ভিদ নতুন উদ্ভিদ তৈরি করে, তেমনই পুরনো ঠেসমূল গাছের দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়। অন্যদিকে গাছের মূল কাণ্ড ধীরে ধীরে তার মূল অবস্থান থেকে সরতে থাকে। এভাবেই প্রতিদিন অল্প অল্প করে স্থান পরিবর্তন করে এই গাছ।
গবেষণা বলছে, প্রতিদিন দেড় থেকে দু সেন্টিমিটার সরণ হয় সেই গাছের। আবার কখনও কখনও দিনে ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্তও অবস্থান পরিবর্তন করতে পার ওয়াকিং পাম। বছর গড়ে ২০ মিটার পর্যন্ত অবস্থান বদলাতে পারে এই গাছ।
পর্যাপ্ত মাটির অভাবে এই গাছের শিকড়গুলি উপরে উঠে আসে এবং ছড়িয়ে যায়। সেখানে আবার নতুন গাছ জন্মায়। আমাজনের আদিবাসীরা এই গাছকে জ্বালানি হিসেবেই ব্যবহার করে থাকেন। গাছগুলো সরু এবং সোজা হওয়ায় ঘরের কাঠামো তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও তাঁরা এই হাঁটা পাম গাছের হলুদ ফলও খেয়ে থাকেন। গাছের শিকড়গুলো এফ্রোডিসিয়াক এবং হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯০০ প্রজাতির গাছের সন্ধান মিলেছে।
তবে শুধু ওয়াকিং পামই নয়, সুমাকো বায়োস্ফিয়ারে রয়েছে বেশ কিছু অদ্ভূত গিরগিটি এবং ব্যাঙের প্রজাতিও। যা এই অরণ্য ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। এই কারণে ইকুয়েডরের এই সংরক্ষিত অরণ্যকে ‘হার্ট অফ দ্য ইউনেস্কো’ তকমা দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শাখা সংস্থা ইউনেস্কো।