আজ বাইশে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস। স্ত্রী, সন্তান থেকে প্রিয়জন বিয়োগ, একের পর এক মৃত্যু, কীভাবে শোক-যন্ত্রণা সামলেছেন কবি? লিখছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র গবেষক স্বপন কুমার ঘোষ।
রবীন্দ্রনাথ যেমন জীবন অনুভবের স্রষ্টা, তেমনি মৃত্যু অনুভবও সেই টানে এসেছে বিচিত্রতায়। শৈশব থেকে বার্ধক্য – শোক দুঃখ আর মৃত্যু ছিল রবীন্দ্রনাথের নিত্য সহচর। সাহিত্য কবিতা চলে জীবন নিয়ে, সেই সঙ্গে মৃত্যুর ছায়া চলে তাঁর সঙ্গী হয়ে।
রবীন্দ্রনাথের বিশাল বিচিত্র ক্রম পরিণতিশীল কাব্য জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দ্রষ্টা কবির দৃষ্টিতে মৃত্যু এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কবির সুদীর্ঘ জীবনে শোক দুঃখ মৃত্যুর আঁধার রাত্রি এসেছে বারে বারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যুর নিপুণ শিল্প চেতনায় বিকীর্ণ হয়ে আছে।
প্রতিবারের মতন আমরা আবার একবার সেই পুণ্য ‘সাগর সঙ্গমে’ এসে দাঁড়িয়েছি। বাইশে শ্রাবণ – জীবনের তাৎপর্যকে চেনায় নতুন করে।
জীবন ও মৃত্যু দুটি পর্যায়। তাই মৃত্যু জীবনের শেষ নয়। মহাকালের ধারায় এ কেবলই একটা রূপান্তর মাত্র। সেকারণে দুঃখ, মৃত্যু, বিরহ ও বিচ্ছেদ – এ সব কিছুর মধ্যে প্রাণের গতিময় ছন্দকে বিশ্বপথিক
মানব-সন্ধানী রবীন্দ্রনাথ স্থান দিয়েছেন সবার উপরে।
তিনি নিজে ছিলেন দীর্ঘায়ু। কিন্তু একের পর এক প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁর সারা জীবনে ছায়া ফেলেছে।রবীন্দ্রনাথের মতন ব্যক্তিত্বই সহজেই বলতে পারেন, “মরণকে মোর দোসর করে/ রেখে গেছ আমার ঘরে/ আমি তারে বরণ করে রাখব পরাণময়।”
১৮৭৫ সালের ১০ মার্চ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে প্রথম মৃত্যুর মুখোমুখি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪ বছর। এই দিন তাঁর জননী সারদা দেবী প্রয়াত হন। একেবারে শেষ রাতের দিকে ঘুম থেকে তুলে, তাঁকে কেউ নিয়ে যান বাইরের বারান্দায়। সেখানে কবির মাতৃদেবীর মৃতদেহ শায়িত ছিল।
তাঁর লেখা ‘জীবনস্মৃতি’ বইটিতে আমরা সেই মুহূর্তের বর্ণনা দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর সে দেহে তাহার কোনোও প্রমাণ ছিল না, সেদিন প্রভাতের আলোকে, মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশস্ত ও মনোহর।”
শিলাইদহে তাঁর বড় ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ মারাযান। ১৮৮৩ সালে, ১২৯০-এর ২৪ অগ্রহায়ণ কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বিবাহ বাসরে সারদাপ্রসাদের মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছয়। এর মাস পাঁচেক পর কবির বৌঠান, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয়, ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল। কাদম্বরীর মৃত্যুকে কবি নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর ভাবেননি। এই মৃত্যুকে তাঁর এক ধরনের মুক্তি মনে হয়েছিল। এর প্রায় ছেচল্লিশ দিন পর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হন।
১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয়। সহধর্মিনীর মৃত্যু কবিকে কঠিন দুঃখ দিয়েছিল ঠিকই, স্ত্রী বিয়োগের পর তাঁর শোকের প্রকাশ ছিল খুবই সংযত। কবি মানসের গঠন তখন পেয়েছে পূর্ণতা। এর কিছুদিন পর তিনি ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থটি লিখেছিলেন। কবি মৃণালিনী দেবীর উদ্দেশে লিখেছেন – ‘ছোঁয়ায়ে দিয়েছ তুমি আপনার হাতে/ মৃত্যুর পরশমণি আমার জীবনে।’
১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় কন্যা রেনুকার মৃত্যু ঘটল। ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে। প্রাণাধিক কনিষ্ঠপুত্র শমীন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যু ঘটল মুঙ্গেরে। এটা ১৯০৭ সালের তেসরা নভেম্বরের কথা। পুত্রের এই অকাল মৃত্যুর শোকে রবীন্দ্রনাথ খুবই ভেঙে পড়েছিলেন।
একের পর এক মারা যান বড় মেয়ে মাধুরীলতা, মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ, ভাইপো বলেন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালের এক বাইশে শ্রাবণে জার্মানিতে তাঁর একমাত্র দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। সর্বশেষে কবির মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে তাঁর আর এক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ মারা যান। এই সব পারিবারিক শোক ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ অনেক প্রিয়জনের মৃত্যুশোকের মুখোমুখি হয়েছেন।
মৃত্যু আমাদের অনেক অপূর্ণতার পরিপূরক। ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাই লিখেছিলেন – “আমি মৃত্যু চেয়ে বড়ো, এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে।”
শান্তিনিকেতনে বাইশে শ্রাবণ দিনটির তাৎপর্য একেবারেই অন্যরকম। এই দিনটিকে পালন করা হয় নবজীবনের উৎসব হিসেবে। কবির প্রয়াণের পরের বছর, ১৯৪২ সাল থেকেই বাইশে শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বৃক্ষ শেখায় পুনর্জীবনের মন্ত্র। বৃক্ষ শিশুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত এই দিনে আকাশ বাতাসে ধ্বনিত হয় বনবাণী-র সুর। এভাবেই বৃক্ষ সম্ভাবনার আকাশ গড়ে ওঠে আবাহনে, মৃত্যুর শোক যায় ঝরে, বাকি সব রূপান্তরিত হয় জীবন-পাথেয় হিসেবে।