হোমফিচারজন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য : মৃণাল সেনের চোখে বিশ্বব‍রেণ্য পরিচালক

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য : মৃণাল সেনের চোখে বিশ্বব‍রেণ্য পরিচালক

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য : মৃণাল সেনের চোখে বিশ্বব‍রেণ্য পরিচালক

(ওঁদের দুজনেই পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দলে পড়েন। এই শহরের বাসিন্দা ছিলেন। কোটি কোটি দর্শক ওঁদের ছবির ভক্ত। দুজনেই আজ নেই। এদিকে এই ভোটের ফল ঘোষণার দিন ২ মে সত্যজিৎ হবেন ১০০। তাঁর জন্মদিন হয়ত রাজনীতির ধুমধামে মানুষ খেয়াল করতে পারবেন না। আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মৃণাল সেন তাঁকে নিয়ে যে লেখা লিখেছিলেন, তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।)

“পথের পাঁচালী” যখন বেরোল, আমি তখন বোম্বাইতে একটি অতি নিম্নস্তরের ছবি করিয়ে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি অতি নিম্নশ্রেণীর কাজের ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। তার আগেই প্রাণ মন এবং আর্থিক সমস্যার দিক থেকে আমার সম্পূর্ণ ছবি করে এবং সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়েও বাজারে বের করতে না পেরে, চূড়ান্ত হতাশায় মগ্ন হয়ে বোম্বাই গিয়ে গুমরোচ্ছি। যত সামান্য মাইনে, কাজের দাবি তত কর্তাদের প্রচন্ড। কাজেই কলকাতায় আসা হয় না। তারপরে দৃঢ় ধারণা হয় যে, সমাজব্যবস্থাকে না পাল্টালে কিছু হবে টবে না। অর্থাৎ উৎসাহেরও অভাব।

এই সময় কানাঘুষোয় খবর পেলাম কলকাতায় “পথের পাঁচালী” ছবিটি বেরিয়েছে এবং যাঁদের মতামতকে আমি শ্ৰদ্ধা করি, তাঁদের কাছে শুনলাম যে, একটা চূড়ান্ত কান্ড ঘটে গেছে।

“পথের পাঁচালী” ছবিটা যখন সত্যজিৎবাবু করছিলেন, তখন আমিও ছবিটা শেষ করে ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলাম। আমার এবং ওঁর দুজনের কাজই এক ল্যাবে হচ্ছিল। কাজে কাজেই টুকরো- টুকরো খবর উড়ো উড়ো ভাবে কানে আসত। যেহেতু তাঁদের গোষ্ঠীও গতানুগতিকতার বাইরে থেকে কাজ করার চেষ্টা করছিলেন, তাই কৌতূহল একটু ছিল।

তারপরে আমার ছবিটা শেষ সেন্সরের পরে বিপর্যয়। চূড়ান্ত হতাশার মধ্যে বম্বের চাকরি পাওয়া এবং আমার চলে যাওয়া। তবু, ভদ্রলোক তারপরেও বেশ কিছুদিন কত কষ্ট ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে ছবিটি শেষ করার চেষ্টা করছিলেন সে খবর পেতাম। কাজেই এখন যখন শুনলাম ছবিটা উতরিয়েছে এবং প্রায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তখন যুগপৎ প্রচণ্ড আনন্দিত এবং খুবই সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলাম ।

আনন্দিত কারণ, তা হলে বোঝা গেল যে, বিভিন্ন কার্য পরম্পরার মধ্য দিয়ে এবং সঠিক যোগাযোগের পথ বেয়ে যদি শেষ অবধি মানুষের সামনে গভীর চেষ্টাকে তুলে ধরা যায়, তা হলে এই অবস্থার মধ্যেও বদল আনা যায়। আর সন্দিগ্ধ এই জন্যে যে, ভদ্রলোককে, তখন আলাপ না থাকলেও, যেটুকু শুনে-দেখে বুঝেছিলাম, তাতে মনে হয়নি যে, বিভূতিভূষণের অপরূপ গ্রামীণ রূপকথাকে উনি সত্যিকারের দরদ দিয়ে তুলে ধরতে পারবেন।কারণ, ওঁর জগৎ, আমি যতটুকু জানতাম, অপুর জগৎ থেকে একেবারেই ভিন্ন।

তারপরেই ঘটনাচক্রে কলকাতায় এলাম এবং ছবিটি দেখলাম। একবার নয় , পর পর সাতবার। অবাক হয়ে গেলাম, আমার সন্দেহ একেবারে অলীক প্রমাণিত হল। এখানে -ওখানে নানা রকম আপত্তি থাকলেও সব মিলিয়ে অপুদুর্গা একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠল, আমার সামনে ফুটে দাঁড়াল।

মনে আছে, তখন বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একটা কথাই বলেছিলাম যে, “পথের পাঁচালী”তে এমন কিছু নেই, যা আমরা হাজারবার ভাবিনি এবং স্বপ্ন দেখিনি। “পথের পাঁচালী” ছবি চিন্তার দিক থেকে বা রচনা শৈলীর দিক থেকে এমন কিছূই আনেনি আমার কাছে ; যা আমি হাজারবার কল্পনা করেছি , স্বপ্ন দেখেছি, উনি সেটা গুছিয়ে গাছিয়ে খেটে তৈরি করে ফেলেছেন।

মারাত্মক এবং প্রচন্ড বৈপ্লবিক তফাৎ। যে তফাৎ ওঁকে আমাদের নবযুগের স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিল, যে আসন থেকে ওঁকে সরাতে কোনোদিনই কেউ পারবে না। “অপরাজিত” যখন হচ্ছে, ততদিনে আমি আবার কলকাতায় ফিরে এসে ছবি করতে আরম্ভ করেছি এবং সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই আলাপ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। “অপরাজিত” আমার মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। মানে অখন্ড একটি ছবি হিসেবে এরও যে জায়গা, জায়গা সম্পর্কে আমার বক্তব্য নেই তা নয়, কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাতে উনি উতরেছেন – “পথের পাঁচালী” বা পরের সব ছবির থেকে অনেক উঁচুতে । “কাঞ্চনজঙ্ঘা” র কথা মনে রেখেই বলছি। যদিও “কাঞ্চনজঙ্ঘা”কে তাঁর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবি বলে আমি মনে করি।

তবু , আমার কেমন যেন মনে হয়, নিজের চিন্তাধারাটাকে এমনভাবে বহুমুখী করে ছড়িয়ে দেওয়াটি তিনি না করলেই পারতেন। তাঁর একজন পরম গুণমুগ্ধ হিসেবেই বলছি যে, এতে যেন অনেকটা শক্তির অপচয় ঘটে গেল। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে।

এই কথাগুলো আমি একজন ছবি করিয়ে হিসেবে বলিনি। বলবার চেষ্টা করেছি একজন শিল্পপ্রেমিক হিসেবেই। আমি ছবি করি আর না করি, বিশেষ করে চলচ্চিত্রটাকে নিয়ে প্রাণপণ ভাবি এবং বুঝতে চেষ্টা করি।

এই সুযোগে কথাগুলো বলার একটা কারণ হচ্ছে, আমি মনে করি ভারতবর্ষে ছবির মাধ্যমটাকে যদি কেউ বোঝে, তবে তিনি হচ্ছেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়। দেখুন, মেজে ঘষে পড়াশুনো করে একটা স্তর পর্যন্ত পৌঁছনো যায়, এমনকি হয়ত প্রবন্ধকার বা ইস্কুলের মাস্টারের স্তর ছাড়িয়ে এক-ধরনের শিল্পীতেও পরিণত হওয়া যায়। কিন্তু জাত শিল্পী হতে গেলে অন্য আর একটা এলেম লাগে।

কিন্তু এই যা বললাম, তারপরেও একটা ব্যাপার থাকে। যেমন ক্লাস করে রবি ঠাকুর হয় না, ইস্কুল মাস্টার হয়। যেমন আর্ট ইস্কুলে রগড়ে রগড়ে পিকাসো বের করা যায় না ! যেমন, ওস্তাদ করিম খাঁর সব ছাত্র ছাত্রীই হীরাবাঈ বরদেকার হয় না। ওটা সেই আরেকটা কিছু, বিশেষ একটা কিছু, এসে যখন খেলা করে তখনই জন্মগ্রহণ করে। সেটা যে কী, সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রইল। এখানে তার স্থান নেই, কারণ, সেটা অত্যন্ত গভীর শান্ত ধ্যানের সামগ্রী।
সেই বিশেষ কিছুটা সত্যজিৎবাবুর মধ্যে ভীষণ ভাবেই আছে, সেটা তাঁর গোড়ার দিকের কাজে লক্ষ্য করা গেছে। ভবিষ্যতে লক্ষ্য করা যাবে কি?

(১৯৭২ সালের মার্চে সিনে-টেকনিক পত্রিকার সত্যজিৎ রায় বিশেষ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সৌজন্য, শ্যামল সান্যাল ।)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img