হোমফিচারBhim Chandra Nag : 'লেডি ক্যানিং' থেকে 'লেডিকিনি'

Bhim Chandra Nag : ‘লেডি ক্যানিং’ থেকে ‘লেডিকিনি’

Bhim Chandra Nag : ‘লেডি ক্যানিং’ থেকে ‘লেডিকিনি’

দেবস্মিতা নাগ
ভোজনরসিক বাঙালির সংস্কৃতির মুকুটে জুড়লো এক নতুন পালক। ১৪টি প্রসিদ্ধ খাবারের দোকান “ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ” বা “ইনট্যাক”(INTACH)-এর কাছ থেকে পেলো “হেরিটেজ”-এর তকমা। আর মেমেন্টো হিসেবে পেল একটি নীল রঙের বিশেষ ফলক। এই প্রথম সরকারি অট্টালিকা ছাড়া অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানকে এই স্বীকৃতি দিল “ইনট্যাক”। এই দোকানগুলি ১৯৬০ সাল বা তারও আগে থেকে কলকাতা পুর এলাকায় একই জায়গা থেকে বাণিজ্য করে আসছে। দীর্ঘ যাত্রাপথে এদের পাথেয় হয়েছে বহু ছোট বড় ঐতিহাসিক ঘটনা। এক কথায় বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে এই খাবারের দোকানগুলি। আর সেই কারণেই মিলেছে এই দুর্লভ সম্মান।

এই পুরষ্কৃত দোকানগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ভীম নাগের মিষ্টির (Bhim Nag Sweet) দোকান। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮২৬ সাল। বউবাজার (Bowbazar) মোড়ের কাছে ৫ নম্বর নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের (Nirmal Chandra Street) এই দোকানটির দেয়াল ঘড়িতে সময় যেন আজও থমকে রয়েছে। হ্যাঁ, এই দোকানের দেওয়াল ঘড়ির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ইতিহাস।

১৮৫৮ সালে লন্ডনের “কুক এন্ড কেলভি” (Cooke and Kelvey) কোম্পানির তখন বিশ্ব জোড়া নামডাক। সেই কোম্পানির মালিক চার্লস কেলভি (Charles Kelvey) একদিন ভীম নাগের (Bhim Chandra Nag) সন্দেশ খেয়ে পরম তৃপ্ত হয়ে এই ঘড়িটি ভীম নাগকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। দু ফুট বাই দু ফুটের এই ঘড়িটির বিশেষত্ব হল, ঘড়িটিতে বাংলা হরফে সংখ্যাগুলি লেখা রয়েছে এক, দুই, তিন, চার….এই ভাবে। ঘড়ি উপহার পাবেন শুনে ভীম নাগ স্বয়ং সাহেবকে বাংলা ঘড়ি দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কারণ, তাঁর দোকানের কর্মচারীরা ইংরেজি পড়তে পারেন না।

বিশেষ বরাত দিয়ে এই ঘড়িটি লন্ডন থেকে বানিয়ে এনে দেন সাহেব। এর মাঝখানে কোম্পানির নাম এবং “লন্ডন” (London) কথাটাও বাংলায় লেখা আছে। কেলভি সাহেব বোধহয় ভেবেছিলেন বাঙালির সবই ভালো, সময়জ্ঞানটা যদি একটু শোধরানো যেত…

সময় আজও ভীম নাগের চার দেওয়ালে আটকে থেকে অনেক কাহিনী বলে। বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালীন সান্ধ্যভ্ৰমণে বেরিয়ে রোজই একবার ভীম নাগ হয়ে বাড়ি ঢুকতেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে যাওয়ার পথে রানি রাসমণির সঙ্গে থাকতো এক হাঁড়ি ভীম নাগ। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সাক্ষী আছে ভীম নাগের তিন মণ মিষ্টি। খোদ রাজা রামমোহন রায়ও মজেছিলেন ভীম নাগের সন্দেশে।

১৮৫৬ সাল নাগাদ সিপাহী বিদ্রোহের প্রাক্কালে যখন গোটা ভারত উত্তপ্ত, সেই সময় ভীম নাগের দোকানে একটি নতুন মিষ্টি তৈরির বায়না এলো। সেই মিষ্টি খাওয়ানো হবে ভারতের শেষ গভর্নর ও প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রী লেডি শার্লট ক্যানিংয়ের জন্মদিনে। ভাইসরয় ও তাঁর স্ত্রীকে খুশি করতে ভীম চন্দ্র নাগ রসে ডোবানো চমৎকার এক ঘিয়ে ভাজা ছানার মিষ্টি বানালেন।

লেডি ক্যানিংয়ের নামানুসারে সেই মিষ্টির নাম হল লেডি ক্যানিং মিষ্টি, যা পরবর্তীতে বাঙালির পাতে “লেডিকিনি” নামে পড়ে। লেডিকিনির নাম যশ আজ ভীম নাগের ষষ্ঠ প্রজন্মের আমলেও বাংলায় অমর।বিখ্যাত খাদ্য ঐতিহাসিক মাইকেল ক্রন্ডল “Sweet Invention: A History of Dessert” বইটিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন। এই ঘটনার উল্লেখ আরো বেশ কয়েকবার ইংল্যান্ডের বিভিন্ন লেখক নানা ভাবে করেছেন।

হুগলি জেলার জনাইয়ের আদি বাসিন্দা প্রাণ চন্দ্র নাগ কলকাতায় এসে বর্তমান দোকানটির জায়গাতেই আদি দোকানটি খুলেছিলেন। তখন খুবই ছোট মিষ্টির দোকান ছিল। পরে তাঁর ছেলে ভীম চন্দ্র নাগের আমলে দ্রুত ফুলে ফেঁপে ওঠে দোকান। মিষ্টির সুদক্ষ কারিগর ভীম একের পর এক তৈরি করেন নতুন নতুন মিষ্টি। বাংলার মিষ্টির ইতিহাসে কড়াপাকের সন্দেশ নামক মাইল ফলক তাঁরই হাতে গড়া।

এই সব ইতিহাস ঘাঁটলে সহজেই বোঝা যায়, মিষ্টি আর বাঙালির প্রেমের মাঝে মধুমেহ কোনওদিনই কাঁটা হয়ে উঠতে পারবে না।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img