হোমদেশCBI: ব্যর্থতার নজির ভুরি ভুরি, প্রশ্নের মুখে বিশ্বাসযোগ্যতাও

CBI: ব্যর্থতার নজির ভুরি ভুরি, প্রশ্নের মুখে বিশ্বাসযোগ্যতাও

CBI: ব্যর্থতার নজির ভুরি ভুরি, প্রশ্নের মুখে বিশ্বাসযোগ্যতাও

(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : কলকাতা পুরসভার ভ্যাকসিন (Vaccine) কেলেঙ্কারি কেসে সিবিআই (CBI) তদন্তের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে এই দাবি তুলেছে বিজেপি। দেবাঞ্জন দেব গ্রেপ্তার হলেও কীভাবে এত বড় কান্ড সম্ভব হল, তার সত্যতা জানতে চান অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সিবিআই তদন্ত করলেই প্রকৃত সত্য জানা যাবে কি?

পরিসংখ্যান বলছে, বিভিন্ন তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) এবং রাজ্যের বাইরে সিবিআই তদন্তের ব্যর্থতার নজির রয়েছে ভুরি ভুরি। ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সাকসেস রেট ৬৫ শতাংশ। এর ব্যর্থতার ইতিহাস বেশ লম্বা এবং হতাশাজনক।

বাবরি মসজিদ (Babri Mosque) ধ্বংস মামলায় ৩২ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিয়ে লখনউয়ের বিশেষ আদালত কার্যত সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। ওই মামলার বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদবের মতে, সিবিআইয়ের যুগ্ম অধিকর্তা, বাবরি-কাণ্ডের প্রধান তদন্তকারী অফিসার মসজিদ ভাঙার পিছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র প্রমাণে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণই হাজির করতে পারেননি। ২৮ বছর তদন্তের পরেও সিবিআইয়ের দিকে সেই ব্যর্থতার অভিযোগই উঠল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এক সময় সিবিআই-কে সরকারের ‘খাঁচার তোতা’র তকমা দিয়েছিল। সিবিআই মূলত রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও হিন্দু সংগঠনগুলোর ৪৯ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছিল। কিন্তু যারা শাবল-গাঁইতি নিয়ে মসজিদ ভেঙেছিল, তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি। মসজিদ ভাঙার সময় ৪২৫ জন আহত হয়েছিলেন বলে সিবিআই স্বীকার করেছে। কিন্তু তাদের কাউকেই অভিযুক্ত করা হয়নি। বিচারক যাদব বলেছেন, “তাদের বক্তব্য নথিবদ্ধ করাও তদন্তকারী অফিসারের দায়িত্ব ছিল। তা থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য মিলতে পারত। কিন্তু সিবিআইয়ের নজরে মূলত রাজনৈতিক দল ও হিন্দু সংগঠনের নেতানেত্রীরাই ছিলেন।”

শুধু সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব নয়। ২৮ বছর ধরে সিবিআই তদন্ত ফৌজদারি দণ্ডবিধি মেনে হয়নি বলেও আদালতের রায়ে স্পষ্ট হয়েছে। সিবিআই ওই দিনের ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজ, ভিডিও ক্যাসেট সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে পেশ করেছিল। কিন্তু নিয়ম মেনে তাতে কোনও সিলমোহর ছিল না। নিরপেক্ষ সাক্ষীর সই ছিল না। বিচারক রায়ে বলেছিলেন, “সিবিআইয়ের পেশ করা কোনও ভিডিও ফুটেজ বা ক্যাসেট সিল-বন্দি অবস্থায় ছিল না। সে সব ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্যও পাঠানো হয়নি। তদন্তকারী অফিসার স্বীকার করেছেন, তদন্ত ফৌজদারি দণ্ডবিধি মেনে হয়নি।”

সারদা কেলেঙ্কারি (Sarada Case) প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্য মন্ত্রিসভার এক প্রবীণ সদস্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) পরামর্শ দিয়েছিলেন, এই তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে৷ কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত না করে মমতা বলেছিলেন, সিবিআইয়ের হাতে তদন্ত তুলে দেওয়ার অর্থ হল ‘দিল্লির হাতে তামাক খাওয়া’। শেষ পর্যন্ত বহু আইনি লড়াই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই সারদা তদন্তের দায়িত্ব নেয়৷ সারদা তদন্তে সিবিআইকে আটকাতে কয়েক  বছর সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ আইনি লড়াই চালিয়েছিল রাজ্য সরকার। মাস খানেক আগে সিবিআই-এর বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ফের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় রাজ্য সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেস৷ সিবিআইকে কেন্দ্রের রাজনৈতিক হাতিয়ার বলার পাশাপাশি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীই।

তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একসময় রানাঘাটের গাংনাপুরের কনভেন্ট স্কুলে সন্ন্যাসিনীকে গণধর্ষণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন সিবিআইয়ের হাতে। প্রায় চার বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বের পর ওই প্রথমবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনও তদন্তের ক্ষেত্রে ‘দিল্লির হাতে তামাক খেতে’ রাজি হন মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে সিআইডি। ওই ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তদন্তের দায়িত্ব সিআইডি-কে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও পরে নবান্নে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (Firhad Hakim) জানান, ঘটনাস্থল আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা,অপরাধীরা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে পারে।

২০১৫ সালের ১৪ মার্চ কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার গাংনাপুরের কনভেন্ট অব জেসাস অ্যান্ড মেরী স্কুলে একদল দুষ্কৃতকারী নৈশপ্রহরী এবং তিন সন্ন্যাসিনীকে বেঁধে রেখে লুটপাট চালায়। একজন দুষ্কৃতকারী দোতলায় উঠে ৭২ বছরের প্রবীণ সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে এই তথ্যই উঠে আসে। যাদের শাস্তি দেওয়া হয় তারা হলো, নজরুল ইসলাম ওরফে নজু, মিলন সরকার, ওহিদুল ইসলাম, মহম্মদ সেলিম শেখ, খালেদ রহমান ও গোপাল সরকার। একজন এখনও পলাতক। সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত বাংলাদেশি নজরুল ইসলাম ওরফে নজুকে আজীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ৫০ হাজার টাকা  জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। বাকি পাঁচজনের মধ্যে বাংলাদেশি চারজনকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা  জরিমানা ধার্য করা হয় । অনাদায়ে আরও আড়াই বছরের কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয় ।

শান্তিনিকেতন (Shantiniketan) থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল (Tagore Novel) চুরির পর কেটে গিয়েছে ১৭ বছর। এখন পর্যন্ত কোনও সাফল্য পায়নি সিবিআই। সেই কারণেই সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রাজ্য পুলিশ দিয়ে তদন্ত করতে চান নোবেল-কাণ্ডের। সিআইডিকে এই তদন্তভার তুলে দেওয়ার জন্য তিনি চিঠিও লেখেন কেন্দ্রকে। সেই দাবিতেই ২০১৭-তে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলার শুনানিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারি সিবিআইকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, “নোবেল আমাদের জাতীয় সম্পদ। অথচ তা উদ্ধারের জন্য সে অর্থে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ এখনও নিতে পারেনি সিবিআই। কেন আপনারা কিনারা করতে পারলেন না এত বছরেও?”

২০০৪ সালের ২৫ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হয়। নোবেল পদকসহ রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালা থেকে ৫০টি মূল্যবান সামগ্রী চুরির কথা জানা যায়। মমতা বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। প্রথম থেকেই তিনি নোবেল চুরির পিছনে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি সিবিআই তদন্তের দাবি করেছিলেন। এর পরদিনই শান্তিনিকেতন গিয়ে সিবিআই তদন্তের কথা ঘোষণা করেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

প্রথমে অবশ্য বীরভূম জেলা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তারপর এই ঘটনার পিছনে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র উঠে আসায় তদন্তভার দেওয়া হয় সিবিআইকে। কিন্তু সিবিআই আধিকারিকরা নোবেল চুরির কিনারা করতে এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ২০০৭ সালের ৩  সেপ্টেম্বর বোলপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিবিআই একটি রিপোর্ট পেশ করে জানিয়ে দেয়, তারা নোবেল চুরির কিনারা করতে পারেনি। কিন্তু নাটক এখানেই শেষ নয়। পরের বছর আবার তারা ওই আদালতে আবেদন করে জানায়, সিবিআই ফের নোবেল চুরির তদন্ত শুরু করতে চায়। আদালত তাতে অনুমোদন দেয়। কিন্তু সিবিআই যথারীতি ব্যর্থ হয়।

২০১০ সাল থেকে সিবিআই কার্যত তদন্ত বন্ধ করে দেয়। সিবিআইয়ের এই ব্যর্থতার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের নেতৃত্বে সিট গঠন করেন। কিন্তু সিবিআই আজ পর্যন্ত তদন্তভার হস্তান্তর করেনি। সিবিআইয়ের তরফে এ প্রসঙ্গে দাবি করা হয়, “আমরা দুবার রিপোর্ট জমা দিয়েছি। নোবেল চুরির কিনারা করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করছি। সিআইডিও তদন্ত করলে তাঁদের অসুবিধা হতে পারে।”

২০০৮ সালের ১৬ মে বছর ১৪-র আরুষি তলোয়ারকে (Arushi Talwar) নয়ডায় ফ্ল্যাটে গলাকাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রথমে বাড়ির পরিচারক হেমরাজকে সন্দেহ করা হলেও, পরে তার দেহও ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে তার পরের দিন উদ্ধার হয়। ছাদের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা ছিল। সেই ঘটনাতেই আরুষি বাবা-মা রাজেশ ও নুপূর তলোয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে নিম্ন আদালত। ২০১৩ সালে রাজেশ ও নূপুর তলোয়ারকে গাজিয়াবাদের সিবিআই আদালত জোড়া খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা শোনায়। পাশাপাশি প্রমাণ নষ্ট ও পুলিশকে মিথ্যা বক্তব্য জানানোর জন্যও তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এরপর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তলোয়ার দম্পতি।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের (Allahabad High Court) ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি এ কে মিশ্র ও বি কে নারায়ণের নেতৃত্বে মামলা শুনতে রাজি হয়। সিবিআইয়ের কিছু তথ্যপ্রমাণে হেরফের থাকায় আদালত ফের মামলা শোনে। 

আরুষি ও হেমরাজ খুন হয়েছেন এটা সত্যি। কিন্তু কে খুন করেছে, তা জানাতে পারেনি সিবিআই। শুধু তাইই নয়, ভারতের অপরাধ ও আইনি ইতিহাসের বিরলতম এই মামলার প্রতিটি ছত্রে প্রমাণিত হয়েছে সিবিআই-এর ব্যর্থতা। শেষ পর্যন্ত এলাহাবাদ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেয় চিকিৎসক দম্পতিকে।

দেশে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এই খুনের তদন্ত প্রথমে শুরু করেছিল উত্তর প্রদেশ পুলিশ। পরে সিবিআই-এর হাতে যায় তদন্তভার। কিন্তু প্রথম থেকেই তদন্তের বিভিন্ন গাফিলতি সামনে এসেছে।আরুষির মৃতদেহ পাওয়ার একদিন পরে মেলে হেমরাজের দেহ। যদিও একই বাড়ির ছাদে হেমরাজের দেহ পড়েছিল। এমনকি সিঁড়িতে রক্তের দাগ থাকলেও, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ছাদে রক্তমাখা হাতের ছাপ পাওয়া গেলেও, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়নি।

তলোয়ার দম্পতির তিন কর্মী, কৃষ্ণা, রাজকুমার ও বিজয়ের নারকো অ্যানালিসিস হয়। কিন্তু তার ভিত্তিতে বিশেষ কোনও তথ্য প্রমানই যোগাড় করা যায়নি। বরং এই তদন্ত চলার সময়েই একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। যখন দেখা যাচ্ছে, কথা আদায়ের জন্য বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। ফলে তদন্তকারী অফিসারদের টিমটাই বদলে দেওয়া হয়। এরপর বেরিয়ে আসে প্রথম তদন্তকারী দলের একের পর এক ভুলের বিষয়গুলো। সিবিআই এই মামলায় চার্জশিট না দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু দিয়েছিল। অর্থাৎ দু’জনের খুনের ঘটনা সত্যি। কিন্তু কে বা কারা খুন করেছে, তা জানাতে পারেনি। আর ওই রিপোর্টেরই সাসপেক্ট লিস্ট কলামে তলোয়ার দম্পতির নাম লিখে দেয়। কিন্তু যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেনি। বরং রাজেশ ও নূপুরই আইন মেনে আদালতে জানিয়েছিলেন, এই তদন্তে তাঁরা সন্তুষ্ট নন। সন্তুষ্ট হল না এলাহাবাদ হাইকোর্টও। যে কারণে বেকসুর খালাস রাজেশ ও নুপূর। আরুষি ও হেমরাজকে কারা খুন করল? জানা দূরের কথা, সিবিআই-এর ব্যর্থতাই প্রমাণ হল।

এইরকম সিবিআই ব্যর্থতার উদাহরণ অনেকই আছে। ধরা যাক, ২ জি কেলেঙ্কারির (2G Spectrum Case) কথা। প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার টুজি কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল সিবিআই। কিন্তু প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যান, তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা এবং ডিএমকে নেত্রী সংসদ কানামোঝি। কারণ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয় সিবিআই। শীর্ষ আদালত ভর্ৎসনা করে সিবিআই অফিসারদের।

এখানেই শেষ নয়, কর্নাটকের বেল্লারিতে অবৈধ কয়লা কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, কয়লা পাচার কান্ড, সারদা, নারদ কেলেঙ্কারি, সিবিআইয়ের ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ। সারদা কেলেঙ্কারিতে মূল অভিযুক্ত মুকুল রায়কে এখনো সিবিআই একবারের জন্য গারদের পিছনে পাঠাতে পারেনি। গরু ও কয়লা পাচার কান্ডে মূল অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র এখন প্রশান্ত মহাসাগরে একটা আস্ত  দ্বীপ কিনে বসে রয়েছে বলে খবর। সিবিআইয়ের নাকের ডগা দিয়ে সে দেশের বাইরে পালিয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে সে এখন সিবিআইয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে ‌।

সাম্প্রতিককালে সিবিআই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা সুশান্ত সিং রাজপুত (Sushant Singh Rajput) মামলায়। আত্মহত্যা না খুন, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে অভিনেতার। তা জানার জন্য প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছিলেন গোটা দেশের মানুষ। পরিবারেরও ছিল একই ইচ্ছে। বিহার সরকারের অনুমোদনে তা পৌঁচ্ছে যায় শীর্ষ আদালতে। সায় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারেরও। অভিনেতার মৃত্যুর দুই মাস চার দিনের মাথায় সিবিআই তদন্তের দাবিতে শিলমোহর দেয় সুপ্রিম কোর্ট। 

২০২০ সালের ১৪ জুন বান্দ্রার কার্টার রোডের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় সুশান্তের দেহ। এরপর প্রায় ৬৫ দিন ধরে এই মামলার তদন্ত করলেও, কোনও এফআইআর দায়ের করেনি মুম্বই পুলিশ। অভিনেতার মৃত্যুর ৪১ দিনের মাথায়, ২৫ জুলাই,২০২০, বিহার পুলিশে এফআইআর দায়ের করেন সুশান্তের বাবা কে কে সিং। তিনি রিয়া চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সুশান্তকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ আনেন। এরপর বিহার সরকারের আবেদন মেনে কেন্দ্র ৫ অগাস্ট এই মৃত্যুর তদন্তভার তুলে দেয় সিবিআইয়ের হাতে। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের সিলমোহর পড়ে ১৯ অগস্ট।

এক বছর পর দিশা হারাচ্ছে সুশান্তের মৃত্যুর তদন্ত। সিবিআই থেকে গোটা মামলা এখন সরে গিয়েছে এনসিবির তদন্তে। বলিউডের মাদকযোগ নিয়েই চলেছে যাবতীয় মিডিয়া কভারেজ। অনেক দিন ধরেই এই বিষয় নিয়ে অসন্তুষ্ট সুশান্তের পরিবার ও অনুরাগীরা। প্রয়াত অভিনেতার মৃত্যুর বিচার চেয়ে সিবিআইয়ের কাছে বারবার কাতর আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।

সুশান্তের মৃত্যুর ফরেনসিক রিপোর্ট কেন এখনও প্রকাশ্যে আনছে না সিবিআই? প্রশ্ন তাঁদের। সুশান্তের মৃত্যুর পরেই বলিউডে ড্রাগ ব্যবসা ও স্বজনপোষণ নিয়ে সরব হয় গোটা দেশ। গোটা বিষয়ে তদন্তের দাবি ওঠে। তলব করা হয় একের পর এক অভিনেতা-পরিচালককে। সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে অভিনেতার পরিবারও। গ্রেফতার হয়েও বেকসুর খালাস হন রিয়া। গ্রেফতার করা হয় সুশান্তের বন্ধু সিদ্ধার্থ পাঠানিকে। কিন্তু সুশান্তের মৃত্যু হত্যা না আত্মহত্যা? সেই প্রশ্নের উত্তর এক বছর পরেও দিতে পারেনি সিবিআই।

ইদানীংকালে দেশের অন্যতম বৃহৎ কেলেঙ্কারি, বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে ‘ব্যাপম কেলেঙ্কারি’। তদন্তে সিবিআইয়ের ব্যর্থতা থেকে এ কথা জোর দিয়ে বলা কঠিন যে, বিগত দু’ বছরে সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা বা কর্মকুশলতা কোনওটিই উল্লেখযোগ্য ভাবে উন্নীত হয়েছে৷

ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত সিবিআই কয়েকজন ছোটোখাটো অপরাধী ছাড়া এর পিছনে সক্রিয় চাঁইদের কারও বিরুদ্ধেই উপযুক্ত সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে তাঁদের শাস্তি সুনিশ্চিত করতে পারেনি৷ এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন সিবিআইয়ের গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর পরিবর্তন৷ তার জন্য সিবিআইকে নির্বাচন কমিশন বা কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল -এর সমকক্ষ মর্যাদা দিতে হবে৷ অর্থাৎ সংস্থাটিকে সরকারের কর্তৃত্ব থেকে সরিয়ে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার ব্যবস্থা করেই একমাত্র তার প্রকৃত স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা সম্ভব৷ তবেই বাড়বে সিবিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img