হোমফিচারনি হাউ, নি হাউ

নি হাউ, নি হাউ

নি হাউ, নি হাউ

শ্যামল সান্যাল : চিনে গিয়েই শুনলাম নি হাউ, নি হাউ। কি রে বাবা! কথাটার মানে কি? সেই মেয়েটিকেই জিজ্ঞেস করি। এক গেল হেসে নিলো। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। বললো, তোমাকে আমি ওয়েল কাম বলছি। কারও সঙ্গে দেখা হলে তুমিও এটা বলে শুরু করবে কথাবার্তা।

চিনের মেয়েরা খুব খুশি হবে, পটিয়ে নিতে সুবিধা হবে। তবে তোমার পকেটের জোর থাকলে তবেই এগিও। না হলে হ্যাঁটা খাবে। পয়সা না থাকলে এ দেশে পাত্তা পাবে না কারও কাছে, বুঝলে বস? একটু ঘাবড়ে যাবার ভান করে বলি, চিন তো কমিউনিস্ট দেশ। তা হলে এত পয়সা পয়সা করছো কেন?

কফিতে চুমুক দিয়ে এদিকে ওদিকে দেখে ফিস ফিস করে বলে, আমরা এখন ক্যাপিটালিস্ট দেশ প্রায়। ও সব কমিউনিজম খায় না মাথায় দেয়? ও দিয়ে কি পেট ভরবে? এ দেশে সাধারণভাবে বাঁচতেও প্রচুর টাকা লাগে। এই যে দুজনে দু কাপ কফি নিয়ে বসেছি, এর দাম মোটামুটি তোমাদের টাকার হিসেবে পাঁচশোর মতো হবে। তোমাদের ওখানে তো খুব বেশি হলেও দুশো টাকার বেশি লাগবে না। বুঝতে পারলে ব্যাপারটা?

হাড়ে হাড়ে বুঝছি, আমার জবাব শুনে ও আবার মিচকি হেসে বলে, ব্যস সোজা কথা যখন বুঝতে পেরেছো, তখন আর কোনও গোল নেই। নাও, আমাদের দেশে তৈরি আমেরিকান সিগারেট ধর। লাইটার দিয়ে আমার মুখে আগুন দিয়ে নিজেরটা ধরিয়ে বলে আমাদের সিগারেটগুলো এত ভাল না।

মেয়েটির নাম বলছি না। কারণ ও বিপদে পড়ে যেতে পারে। এই ধরনের কথাবার্তা বলার দায়ে জেল হতে পারে। প্রাণ খুলে মমতা বা মোদির গুষ্ঠির তুষ্টি করা যায় এই দেশে। ওখানে নয়। এই মেয়েটি কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিল। তখন ভাব হয়েছিল। ঝরঝরে ইংরেজি বলে, আড্ডাবাজ। ওখানে ট্যুর গাইডের কাজ করে। কলকাতার বড় ট্রাভেল এজেন্সি ছাড়াও ইউরোপের বেশ কিছু নাম করা কোম্পানি ওর কাছে লোকজন পাঠায়।

ওর বয়স তিরিশের বেশি নয়। মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস নাকি করতে নেই। চিনের মেয়েদের কত বয়স, বোঝা বহুত কঠিন। পঞ্চাশের প্রবীণাকে পঁচিশের খুকি মনে হবে। কারণ ওরা দারুণ মেন্টেন করে নিজেদের।

তিরিশের প্রজন্মের চিনে ছেলেমেয়েদের কাছে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের গুরত্ব নেই। ওখানে তিরিশ বছর আগে ছাত্রদের আন্দোলন রুখতে পুলিশ আর সেনাদের গুলি কামানের গোলা হাজার দশেক ছাত্র ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। এই বিষয়ে চিনে কোনওরকম আলোচনা নিষিদ্ধ।

ঘটনাটা ঘটেছিল 1989-এ। মে মাসের গোড়া থেকে পিকিং ইউনিভার্সিটির একদল ছাত্রছাত্রী সুশাসনের দাবিতে ওখানে ছোট জমায়েত করে শ্লোগান দিতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বড় হয় সেই জমায়েত। ঝাও জিয়াং আর সময় দেননি। জুনের 3/4 তারিখে শুরু পুলিশ সেনা অপারেশন। সারা পৃথিবী চমকে উঠেছিল। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল সারা পৃথিবীর ছাত্র সমাজ। সেসব কথা চিনে উচ্চারণ করা আজ ও নিষিদ্ধ।

ওখানে আমি গিয়ে দেখলাম ঝকঝকে সুন্দর সাজানো একটা টুরিস্ট স্পট।চিনের সেই বিখ্যাত নেতা মাও জে দঙ্গের মরদেহ বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত এখানে। লাখ লাখ দেশি বিদেশি পর্যটক তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে ওখানে যান। একটুও শব্দ নেই, যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সেনা আর পুলিশ সব ব্যাপারটা দেখা শোনা করে। কিন্তু আমাদের পুলিশের মতো হম্বি তম্বি নেই। ভেতরে মাওয়ের কাঁচে ঢাকা মরদেহের কাছে গেলেই মনে হয় , এই বুঝি উঠে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের জন্য সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলবেন।

মনে পড়ে যায় কলকাতার দেয়ালে দেয়ালে সত্তরের দশকে লেখা হত, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।

তিরিশ বছরে সারা দুনিয়া একেবারে বদলে গেছে। পুরোনো ধ্যান-ধারণা বদলে চিন এখন পৃথিবীর সব থেকে ধনী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক আর বেজিংয়ের বৈভবের কোনো তফাৎ নেই। যে ছেলেমেয়েগুলো তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে গুলিতে মরেছে, তাদের কথা কে মনে রাখবে, কার দায় পড়েছে, কার মাথা খারাপ হয়েছে?
কলকাতা আর সেই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা, রাষ্ট্রের গুলিতে খুন হওয়া ছেলেদের কথা কে মনে রাখে শপিং মলের মসৃণ ফ্লোরে ঘুরতে ঘুরতে?

ক্রমশ…

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img