হোমরাজ্যDurga Pujo : সেকাল থেকে একাল, সময়ের সরণি বেয়ে বাংলার দুর্গাপুজো

Durga Pujo : সেকাল থেকে একাল, সময়ের সরণি বেয়ে বাংলার দুর্গাপুজো

Durga Pujo : সেকাল থেকে একাল, সময়ের সরণি বেয়ে বাংলার দুর্গাপুজো

sandip atcসন্দীপ ব্যানার্জি, শিক্ষাবিদ

শরতের প্রারম্ভে মাঠের ধারে মাথা নাড়া শুভ্র কাশফুল ও পেঁজা তুলো মেঘের আনাগোনার সাথেই বাঙালির গৃহপ্রাঙ্গণে এসে পৌঁছয় ঢাকের বোল ও পুজো-পুজো গন্ধ। দুর্গাপুজো যদিও বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, ইতিহাস ঘাঁটলে প্রমাণ মেলে যে, দুর্গাপুজো ও বাঙালির সম্পর্ক কিন্তু বিশেষ পুরোনো নয়। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ বাহিনীর হাতে সিরাজদৌল্লার মর্মান্তিক পতনের পর ইংরেজকুলের বিজয় উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং শোভাবাজার রাজবাড়ির নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরে এই পুজোর সূচনা।

কিন্তু ক্রমে কালের সরণি বেয়ে কীভাবে দুর্গাপুজো রাজবাড়ি-জমিদার বাড়ির আঙিনা ছেড়ে বেরিয়ে সবর্জনের অর্থাৎ ‘সর্বজনীন’ হয়ে উঠল, তা ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। সময়ের সাথে সবকিছুর মতো দুর্গাপূজাও হাজার পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এবং এখনও চলবে। বাঙালি সাবেকি পুজো প্রথাকে যেমন সাদরে গ্রহণ করেছিল, তেমনি অধুনাকালের এই বদলগুলোকেও আগলে ধরেছে ভালোবেসে। কারণ এ তো কেবল পূজা নয়, দুর্গাপূজা আসলে মানবের এক মহামিলন উৎসব।

প্রাচীন কলকাতা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক কঠিন সত্য এই যে, ইংরেজরা কলকাতার বিত্তশালী পরিবারের পুরুষদের অর্থাৎ ‘বাবুদের’ কাঁধে চেপেই এদেশে তাদের ভিত শক্ত করেছিল।

১৭৫৭ সালের জুন মাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজদৌল্লা পরাজিত হলেন। ইতিহাস বলছে, এই হারের মাশুল ভবিষ্যতে ভারতবাসীকে দিতে হয়েছিল তাদের স্বাধীনতা দিয়ে। কিন্তু এই পরাজয়ে বিশেষ খুশি হয়েছিলেন দুই ব্যক্তি—নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির আদি পুরুষ নবকৃষ্ণ দেব। বাঙলার দুর্গাপুজো শুরু এঁদের হাত ধরেই। এঁরা দুর্গাপুজোকে একরকম সাহেবদের খুশি করার পথ হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, এদেশের মঙ্গলের জন্য সাহেবদেরই প্রয়োজন। লর্ড রবার্ট ক্লাইভ নিজের বাকচাতুর্যের মাধ্যমে একথা তাঁদের বুঝিয়েছিলেন যে, এই জয় আসলে হিন্দুদের জয়। এমনকি, ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর, হিন্দু রাজাদের মন ধরে রাখার উদ্দেশ্যে লর্ড ক্লাইভও একবার পুজোর আয়োজন করেন।

শোনা যায়, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় নাকি ক্লাইভ তাঁর পারিষদবর্গকে নিয়ে এসেছিলেন এবং একশো টাকা দক্ষিণা সহ পুজোয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর আগে মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা শরৎকালে হতই না, তা হত বসন্তকালে। কিন্তু সাহেবদের খুশি করার জন্য বসন্তকালের পুজো ও শরৎকালের নবপত্রিকা—এই দুইকে এক করে নতুনরূপে দুর্গাপুজো চালু হল। এভাবেই ধনী পরিবারের আঙিনায় এ পুজোর শুরু। সেকালে দুর্গাপুজোর পরিধি কেবলমাত্র অভিজাত ধনী পরিবারগুলিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ মানুষের জন্য এ পুজোর দ্বার উন্মুক্ত ছিল না, আনন্দোৎসবে তাদের কোনো ভাগ ছিল না। যে বাড়িতে পুজো হত, তাঁদের আমন্ত্রণে যারা আসতেন, কেবল তাঁরাই দুর্গাপুজোর আনন্দ পেতেন।

এ ছাড়া, দুর্গাপুজোর আনন্দোল্লাসের একটি বিশেষ দিক ছিল সাহেবদের নিমন্ত্রণ করা। সাহেবরা সদলবলে পুজো দেখতে আসত, এমনকি তাদের মনোরঞ্জনের জন্যও থাকত বিশেষ ব্যবস্থা। বাঈজি নাচ বসত, সারারাত ধরে চলত জলসা। শোনা যায়, সাহেবদের খুশি করার জন্য নাকি সুদূর বার্মা থেকে বাঈজি আনিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়িতে জলসা বসত। অবিরাম সুর ও অশেষ সুরার জোগান—এই দুই মিলেমিশে এক ঝলমলে পরিবেশ তৈরি হত। কিন্তু সে আলোর ঝলকানি বনেদি বাড়ির বাইরের আঁধারকে ছুঁতেও পেত না।

মা দুর্গা বাঙালিদের কাছে একরকম ঘরের মেয়েই। ঘরের মেয়ে পুজোর কালে সন্তান-সন্ততি সহ শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি আসে। দশমীতে সকলকে কাঁদিয়ে মেয়ে ফিরে যায় কৈলাসে তাঁর স্বামীর কাছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, মা দুর্গার চালচিত্রের যে বর্তমান রূপ—সেখানে দশভুজা দেবী তাঁর চার সন্তান—লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ সহ বিরাজমান। এই যে এক পারিবারিক রূপের প্রকাশ, এই চালচিত্র প্রথম ব্যবহৃত হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই। এর আগে কেবল দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপটাই জ্ঞাত ছিল। কিন্তু পরে দেবীর পারিবারিক রূপটাই মানুষের কাছে বেশি আপন হয়ে ওঠে।

পুরোনো কোলকাতার লোকের মুখে মুখে ফিরত যে, মা দুর্গা নাকি মর্ত্যে প্রথম পা রাখেন হুগলি নদীর তীরে। সেখান থেকে মা যান শিবচন্দ্র দাঁর বাড়িতে গয়না ও কাপড় পড়তে। তারপর সুসজ্জিতা মা অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে যান মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে এবং দিনের শেষে মা শোভাবাজার রাজবাড়িতে যান বাঈজি নাচ দেখতে। কিন্তু কেন এই জনশ্রুতি? এই সব পরিবারগুলি তাদের বিত্তের জন্য খ্যাত ছিল।

শোনা যায়, সেই সময় দাঁ বাড়িতে লোকে নাকি প্রতি ঘণ্টায় কাপড় বদলে নতুন কাপড় পড়তো। মিত্রবাড়িতে নাকি জিলিপি বানানো হত প্রায় রথের চাকার সাইজের এবং দুপুরে রাঁধা হত একশটি পদ। শোভাবাজার রাজবাড়ির বাঈজি নাচের জলসা ছিল সুবিদিত। যদিও এ সবই জনশ্রুতি, তবুও যা রটে তার কিছুটা তো বটে।

দুর্গাপুজোকে ঘিরে কোলকাতার বাবুদের শখ-শৌখিনতার গল্প অন্তহীন। কলকাতার বিখ্যাত ধনী বাবু প্রদ্যুম্ন মল্লিক। একসময় তাঁর মনে হল, এই যে সাধারণ মানুষ দুর্গাপুজোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত, এ বিষয়ে কিছু করা দরকার। যেমন হুজুগ, তেমনি কাজ! বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হল ক্রিস্টালের তৈরি এক অপূর্ব দুর্গামূর্তি। সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্য প্রদ্যুম্ন মল্লিক সেই মূর্তি রোলস্ রয়েস গাড়িতে চাপিয়ে সারা কলকাতা ঘোরালেন। ১৮৪২-৪৩ সাল পর্যন্ত সাহেবরা বাবুদের বাড়ির পুজোয় নিয়মিত যেতেন। পরে কোনো সরকারি কারণবশত তা অনেক কমে যায়।

বনেদি বাড়ির আঙিনা ছেড়ে দুর্গাপুজো বারোয়ারি হল কীভাবে? সালটা ১৭৯০। হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বারো জন যুবক ভাবলেন দেবীর আরাধনা কেবল ধনীরাই কেন করবে, সাধারণ মানুষ কেন নয়, এই বারোজনই প্রথম বনেদি বাড়ির বাইরে দুর্গাপুজোর পত্তন করল। বারো ‘ইয়ারি’ কথা থেকেই ‘বারোয়ারি’ শব্দের প্রচলন। বারোয়ারি পুজো দিয়েই ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্গাপুজোর উদ্‌যাপন শুরু হল। পুজো থেকে দুর্গাপুজোয় পরিণত হল উৎসবে।

এবার আসা যাক, সত্যিকারের সর্বজনীন পুজোর পত্তনের ইতিহাসে। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো করলেন। মঠের দ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৯০৯ সালে ভবানীপুরের ‘সনাতন সভা’ আয়োজিত পুজোয় সর্বসাধারণকে যুক্ত করার একটা প্রয়াস দেখা গেল। এই পুজোয় প্রথম নিজের দুর্গাস্তোত্র পাঠ করলেন ঋষি অরবিন্দ। এর বছর দশেক পরেই, ১৯১৯ সালে বাগবাজারে একটি সর্বজনীন ধাঁচের পুজো আয়োজিত হল। বাগবাজারের প্রদর্শিত পথে হেঁটে ১৯২৬ সালে কলকাতার ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’ সকলের জন্য আয়োজন করল দুর্গাপুজো। এ পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বহু ইতিহাসবিদের মতে, এই পুজোই কলকাতার প্রথম প্রকৃত সর্বজনীন দুর্গোৎসব। ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম মিলেমিশে পুজোর আনন্দ দ্বিগুণ করে দিল। এভাবেই মা দুর্গা অভিজাতের কোল ছেড়ে বাঙলার প্রতিটা মানুষের আপন হয়ে গেলেন।


সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মা দুর্গার রূপের পরিবর্তনও তাৎপর্যপূর্ণ। সে রূপে আজকের মতন এমন অভিনব থিমের কারিগরি, কিংবা থিম অনুযায়ী মণ্ডপসজ্জা, প্রতিমাসজ্জা ছিল না। প্রতিমাকে কেন্দ্র করে আজকাল কলকাতার ক্লাবে ক্লাবে পুজোর লড়াই এক বহু চর্চিত বিষয়। অবশ্য এসব আধুনিকতা সত্ত্বেও আজও দুর্গাপ্রতিমার সনাতনি ডাকের সাজ একইরকম জনপ্রিয়। এই যে ডাকের সাজ, এই সাজের মূল উপকরণ বিটেন সিলভার সেকালে আনানো হত জার্মানি থেকে পোস্টের মাধ্যমে অর্থাৎ ‘ডাক’-এ। তাই এর নাম হয়ে দাঁড়ায় ডাকের সাজ।

মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক শুরু করেছিলেন বিখ্যাত ‘গণেশ উৎসব’। এর সাথে সব মানুষকে একজোট করার মধ্যে দিয়ে একরকম জাতীয়তাবাদের যোগ ছিল। বাঙালির দুর্গাপুজোও সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর সাথে স্বদেশি ভাবের জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এ এর খানিক আভাস মেলে। মা দুর্গা তো আসলে দেশের মা, বিপত্তারিণী, যিনি ইংরেজদের অত্যাচারের হাত থেকে পরাধীন ভারতবাসীকে রক্ষা করবেন।

দুর্গাপূজা কি কেবল আনন্দরেই উৎসব? নাকি এর সাথে সামাজিক কাঠামোর কোনো গূঢ় যোগ আছে? দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে আছে কত শত মানুষের জীবিকা উপার্জন। মৃৎশিল্পী, মণ্ডপশিল্পী, কারিগরের দল, ঢাকি, পুরোহিত, পুজোর জলসার গায়ক-বাদকেরা, বস্ত্র ব্যবসায়ী, দর্জি—এমনি হাজারো মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই ক-টা দিনের জন্য। এই ক-দিনের উপার্জনেই বহু মানুষের সারা বছরের অন্ন সংস্থান হয়। সেকালে বাবুদের পুজোর সময় জলসা বসত। পুজো সর্বজনীন হবার পরেও সেই জলসার রেশ ধরে বিভিন্ন জায়গায় পুজোর সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে শুরু হয় পুজো উপলক্ষ্যে ‘পুজোর গান’ রেকর্ড করার চল। আজও এই ধারা অব্যাহত। আজও পুজোর সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীরা ছুটে বেড়ান দেশবিদেশের নানান প্রান্তে।

আজকের এই করোনা-ক্লান্ত বছরেও যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে, নামমাত্র খরচা হলেও কলকাতায় দুর্গাপুজো হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অতিমারীর মধ্যে রংহীন দুর্গাপুজোর যে অভিজ্ঞতা বাঙালির হল, পরের বছর যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়। এই আশাতেই বুক বেঁধেছে সকলে। কারণ দুর্গাপুজো আজ আর কোনো বিশেষ ধর্মের বা জাতির বা দেশের নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ে, জাতীর মেলবন্ধনে, আন্তর্জাতিকতায়, দুর্গাপুজো আজ সত্যিই সর্বজনীন। আর এই সর্বজনীন দুর্গোৎসব বাঙালির কাছে কেবল উৎসব নয় ― আবেগ।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img