পুলক মিত্র : সংসদের বাদল অধিবেশনের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দিল্লি সফর ঘিরে রাজনৈতিক মহলের চর্চায় ফের উঠে আসছে বিরোধী জোট প্রসঙ্গ। খাতায়-কলমে লোকসভা (Loksabha) ভোটের এখনও প্রায় ৩ বছর বাকি। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata) সরকারের হ্যাটট্রিকের পর জোট গড়ার প্রক্রিয়া ক্রমশ গতি পেতে শুরু করেছে। বলতে গেলে, এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন স্বয়ং মমতা।
২০১৪ বা ১২০১৯-এর আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে জোট গড়ে লড়াইয়ে নেমেছিল বিরোধী দলগুলি। কিন্তু শুধুমাত্র নরেন্দ্র মোদিকেই (Narendra Modi) মুখ করে সাফল্য পেয়েছিল গেরুয়া শিবির। অন্যদিকে, মোদির বিরুদ্ধে কোনও মুখ তুলে ধরতে পারেননি বিরোধী নেতারা। প্রধানমন্ত্রী বাছাই হবে ভোটের পরে, বিরোধী নেতাদের এই তত্ত্বে খুব একটা ভরসা রাখতে পারেননি দেশবাসী। তাই প্রবল মোদি-বিরোধী হাওয়া সত্ত্বেও ২০১৯-এ ৩০০-র বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি।
মোদিকে গদিছাড়া করার ডাক দিলেও, এই মুহূর্তে বিরোধী শিবিরের অত্যন্ত ছন্নছাড়া অবস্থা। এর মধ্যে একমাত্র কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অস্তিত্ব থাকলেও, কোন্দলে জেরবার ১৩৫ বছরের এই দলটি। রাহুল গান্ধীর খামখেয়ালি রাজনীতি দলকে দিন দিন দুর্বল করছে। সোনিয়া গান্ধী (Sonia Gandhi) অসুস্থ। তাই তিনি আগের মতো দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না। অন্যদিকে, রাহুল (Rahul) সোশ্যাল মিডিয়ায় যতটা সক্রিয়, মাঠে ময়দানে ততটা তৎপর নন। তাই রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের আজ হতশ্রী চেহারা।
আবার এটাও সত্যি, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী জোট হতে পারে না। কংগ্রেসকে বাদ দিলে, বাকি সবকটি দলের জাতীয় স্তরে কোনও উপস্থিতিই নেই। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় সর্বভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় মুখ হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচন বুঝিয়ে দিয়েছে, মোদির বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেন মমতাই। তাই বিরোধী শিবিরের নেতারা মমতাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। মমতাকে বিশেষভাবে পছন্দ করেন সোনিয়া গান্ধী। রাহুলের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভালো। মহারাষ্ট্রের শিবসেনা মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে থেকে এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, বিরোধী পক্ষের সব নেতার সঙ্গেই মমতার সুসম্পর্ক রয়েছে। এটা মমতা নিজেও ভালো করে জানেন। তাই অপেক্ষায় না থেকে এখন থেকেই জোট গড়তে তৎপর হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিরোধী নেতাদের মধ্যে অনৈক্যেই এই মুহূর্তে ভারতে জোট রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। সন্দেহ নেই, করোনা দেশের মানুষকে কঠিন সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেইসঙ্গে মোদি সরকারের একের পর এক ভুল নীতি সেই সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মোদির (Modi) জনপ্রিয়তার গ্রাফ দ্রুত নামছে। তাই দেরি না করে মোদির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রচারে নামার এটাই যে আদর্শ সময়, তা বুঝতে পারছেন মমতা। কারণ, মোদি বিরোধী কর্মসূচির মধ্যে দিয়েই নেতারা পরস্পরের কাছাকাছি আসবেন। তাতে নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়বে। পোক্ত হবে জোটের ভিত।
আর নেতাদের কাছাকাছি আনার এই গুরুদায়িত্ব মমতা তুলে দিয়েছেন পিকে-র হাতে। প্রশান্তের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে মমতা বুঝতে পেরেছেন, এই কাজে তিনিই যোগ্যতম ব্যক্তি। পিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র বা গতিপ্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে একজন পোড় খাওয়া নেতার চেয়ে তিনি কোনও অংশে কম যান না।
এখনও পর্যন্ত যে কাজে হাত দিয়েছেন, তাতে সাফল্যের শেষ হাসি হেসেছেন তিনিই। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এই রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসনে জয়ের পর তৃণমূলের অন্দরের ছবিটা এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। বাংলা দখলের জন্য সর্বস্ব পণ করে লড়াইয়ে নেমেছিল বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে দলের তাবড় তাবড় নেতারা বাংলার মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন।
কিন্তু আত্মবিশ্বাসী প্রশান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপির আসন সংখ্যা ১০০ ছাড়ালে, তিনি আর ভোটকৌশলীর কাজ করবেন না। ফল বেরোতেই দেখা গেল, বিজেপির আসন ৮০ ছাড়ায়নি।
২০১৪তে মোদির জয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন প্রশান্ত। এরপর বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর পাঞ্জাবের অমরিন্দর সিং, অন্ধ্রপ্রদেশের জগন মোহন রেড্ডি থেকে দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল কিংবা তামিলনাড়ুর এম কে স্ট্যালিন এবং সবশেষে মমতা ব্যানার্জি, একে একে অনেক দেশের অনেক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই কাজ করেছেন পিকে।
২০১৭তে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির জোটের সুবাদে রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে কিশোরের। যদিও এই জোট ক্ষমতায় আসতে পারেনি। গত ৭ বছরে এটাই একমাত্র পিকে-র সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এছাড়া অন্যত্র তাঁর কৌশল কখনও মুখ থুবড়ে পড়েনি। কারণ, বাস্তবের মাটিতেই দাঁড়িয়েই তিনি যাবতীয় অঙ্ক কষেন। তাঁর নিজস্ব টিম রয়েছে। সেই টিমের মাধ্যমে রীতিমতো ফিল্ড-ওয়ার্ক করে কার, কোথায়, কী ঘাটতি রয়েছে, তা খুঁজে বার করার চেষ্টার করেন। এটাই প্রশান্তের ইউএসপি।
২০২৪-এ বিরোধীরা চাইছেন মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। কিন্তু চাইলেই তো হল না। তার জন্য চাই সুনির্দিষ্ট কৌশল, সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি, যা একমাত্র প্রশান্তের পক্ষেই করা সম্ভব। বাংলায় এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের পিছনে মমতার জনপ্রিয়তা অবশ্যই বড় কারণ। কিন্তু এই জয়ের পিছনে কাজ করেছে পিকে-র ক্ষুরধার মস্তিষ্কও। স্লোগান থেকে তৃণমূল স্তরে প্রচারের ছক, সবই তৈরি করে দিয়েছে টিম পিকে। সেইসঙ্গে এই জয়ের সূত্রে মমতাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা অপরাজেয় নন।
বাংলার জয়কে অক্সিজেন করে আর প্রশান্তের কৌশলের ওপর ভরসা করে এখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ঝাঁপ দিয়েছে তৃণমূল। তাদের লক্ষ্য একটাই, বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সঠিক পথে এগোলে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব, এমনটাই মনে করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলায় তৃণমূলের জয়ের পর এখন পিকে গোটা ভারত চষে বেড়াতে শুরু করেছেন। মুম্বইয়ে গিয়ে শরদ পওয়ারের সঙ্গে ৩ বার একান্তে কথা বলেছেন। এরপর দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা বঢরার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিরোধী শিবিরের নেতাদের এক ছাতার তলায় আনতে প্রশান্ত কী কৌশল নেবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে যে ধরনের বিরোধী জোট হয়েছে, আগামী লোকসভা ভোটে তেমনটি যে হবে না, তার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন প্রশান্ত।
আগামী লোকসভা ভোটের আগে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হবে। সেইসব নির্বাচনের ফলাফল কী দাঁড়াবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তবে বিধানসভা আর লোকসভার ভোটের অঙ্ক সবসময় মেলে না।
করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা থেকে পেট্রোপণ্যের বেনজির মূল্যবৃদ্ধি, নরেন্দ্র মোদিকে বিপাকে ফেলার জন্য বিরোধীদের হাতে অনেক ইস্যু রয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, নিজেদের মতবিরোধ সরিয়ে বিরোধী দলগুলি কি একসঙ্গে কাজ করতে পারবে? বিরোধী নেতারা নিজেদের ব্যক্তিগত উচ্চাশা, অহংবোধকে পিছনে ফেলে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ময়দানে নামতে পারবেন কি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন, এমন কোনও মুখ দেশবাসীর সামনে বিরোধী নেতারা হাজির করতে পারবেন কি?
সব বিরোধী দলকে একমঞ্চে আনা যে কঠিন, তা ভালো করেই জানেন পিকে। সেকথা মাথায় রেখেই তাঁকে এগোতে হচ্ছে। জল কোন দিকে গড়াবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে একটা কথা বলা যায়, ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে আগামী দিনে এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে উঠতে চলেছেন প্রশান্ত কিশোর।