হোমPlot1মিশন মৌসম আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে

মিশন মৌসম আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে

মিশন মৌসম আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে

ভারতের আবহাওয়া ব্যবস্থায় বড়সড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘মিশন মৌসম’। এর ফলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রায় ১০০ শতাংশ নিখুঁতভাবে দেওয়া যেমন সম্ভব হবে, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানীয়ভাবে আবহাওয়ার ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তার মোকাবিলা করাও সম্ভব হবে।

আবহাওয়া-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশিষ্ট পডকাস্টার ও সাংবাদিক প্রতিম রঞ্জন বসুর নানা প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের সদর কার্যালয় দিল্লির মৌসম ভবনের মহা নির্দেশক ডঃ মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র।

ডঃ মহাপাত্র জানান, আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে রাডারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ঘনত্ব এখন চার-গুণ বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির দিকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। ফি বছর আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। তাতে সমস্যায় পড়ছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। বিগত দুই-তিন বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অংশে তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে যে বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা অতীতে কখনও ঘটেনি। তাই এখন পঞ্চায়েত স্তরেও নজরদারি ব্যবস্থাকে জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু।

বর্তমানে তাপপ্রবাহের মতো ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা আগে ৯৭.৯৯ শতাংশ সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। অন্যদিকে, বৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পূর্বাভাস মাত্র ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে বজ্রপাতও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বজ্রপাতের বলি হন অসংখ্য মানুষ। ডঃ মহাপাত্র বলেন, বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে এখন এই সংক্রান্ত পূর্বাভাস অনেক সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, যার ফলে প্রাণহানির সংখ্যা কমছে। ডঃ মহাপাত্র জানান, শিল্প, জাহাজ চলাচল, বিমান পরিবহন এবং বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও আবহাওয়া-সংক্রান্ত পূর্বাভাস বিশেষ উপযোগী হয়ে উঠেছে।

ভারতে ভৌগোলিক ও জলবায়ু বৈচিত্র্যের কারণে, আবহাওয়া এবং বর্ষার প্রকৃতির ওপর নানাভাবে প্রভাব পড়ে। প্রাথমিক জীবনধারণের সঙ্গে কৃষি যুক্ত হওয়ায়, স্বাভাবিকভাবেই সঠিক আবহাওয়ার পূর্ভাভাস এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর নরেন্দ্র মোদী সরকারের অধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পৃথ্বী বিজ্ঞান মন্ত্রক মিশন মৌসম নামে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ অনুমোদন করে। এই উদ্যোগে দু’বছরের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয় ২,০০০ কোটি টাকা। এই বছরের ১৪ জানুয়ারি মিশন মৌসম-এর সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

এর লক্ষ্য হল, সময় ধরে আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাসকে আন্তর্জাতিক মানের উপযোগী করে তোলা। কৃষি, বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাপনা এবং গ্রামোন্নয়নের মতো নানাবিধ ক্ষেত্রের জন্য আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঠিক পূর্বাভাসে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পৃথ্বী বিজ্ঞান মন্ত্রকের নেওয়া এই উদ্যোগে সামিল করা হয়েছে মন্ত্রকের অধীন প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান, ভারতীয় আবহাওয়া দফতর (আইএমডি), ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্টিং (এনসিএমআরডব্লিএফ) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিরিওলজি (আইআইটিএম)। এছাড়াও অন্যান্য সহায়ক সংস্থা যেমন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান ইনফরমেশন সার্ভিসেস (আইএনসিওআইএস) এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওশান টেকনোলজি (এনআইওটি)কেও এই উদ্যোগে সামিল করা হয়েছে। 

নানা ক্ষেত্রে মিশন মৌসম অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কৃষি ভিত্তিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৃষ্টির খামখেয়ালি চরিত্রের ফলে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পায়। বর্ষার সঠিক পূর্বাভাসে বীজ বোনা, সেচ পরিকল্পনা এবং ফসল তোলার সঠিক পরিকল্পনা আগে থেকেই করে তোলা সম্ভব। অনুরূপভাবে বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও তা অত্যন্ত জরুরি। ভারতকে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরার মতো চরম পরিস্থিতির প্রায়শই মুখোমুখি হতে হয়। সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জীবন এবং সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নত জলবায়ু পরিষেবা গ্রামে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা, পশুখাদ্য রক্ষা এবং পরিকাঠামো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নানা ভাবে সাহায্য করতে পারে। 

মিশন মৌসমের উদ্দেশ্য হল, স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবস্থা সহ ঋতুভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ভারতের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। প্রথম ক্ষেত্রে এক থেকে সাত দিন আগে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, এক সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহ আগে এবং তৃতীয় ক্ষেত্রে, এক মাস থেকে এক বছর আগে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। বর্ষার চরিত্র কী রকম হতে পারে, তা যথাযথ নির্ণয়ের জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মডেল গড়ে তোলা। উন্নতমানের রাডার, উপগ্রহ এবং স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করে তোলা। কৃষি, জলসম্পদ, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য এবং বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাপণা ক্ষেত্রে কার্যকরী পরামর্শদানের ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যৌথ গবেষণার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। 

মিশন মৌসম তার লক্ষ্য পূরণে রূপায়ণগত নানা কৌশল হাতে নিয়েছে। এক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে দেশ জুড়ে ডপলার ওয়েদার রাডার্স (ডিডব্লুআরএস), স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া কেন্দ্র (এডব্লিএস) এবং বৃষ্টির পরিমাপগত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রত্যুষ এবং মিহিরের মতো  উন্নতমানের জলবায়ু মডেলিং-এর সুপার কম্পিউটার শক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। জলবায়ু পূর্বাভাস কৌশলের আরও প্রসার ঘটাতে বিশ্ব জলবায়ু সংগঠন (ডব্লুএমও)-র মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও, জন-বান্ধব মোবাইল অ্যাপ- যেমন মৌসম অ্যাপ, এসএমএস পরিষেবা এবং গণমাধ্যগুলিতে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত পূর্বাভাস সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। 

বর্তমানে সময় বেঁধে জলবায়ু পূর্বাভাসের জন্য ৩৭টিরও বেশি আবহাওয়া ডপলার স্থাপন করা হয়েছে। মৌসম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দেশের ৪৫০টি শহরে এলাকা ভিত্তিক আবহাওযার পূর্বাভাস পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় মনসুন মিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঋতুভিত্তিক জলবায়ু নির্ণয়ের মডেলগুলি প্রভূত উন্নতিসাধন ঘটিয়েছে। এছাড়াও মন্ত্রক শহরাঞ্চলে বন্যার পূর্বাভাস এবং ঘূর্ণিঝড় নির্ণয়ে অনেক উন্নতমানের কর্মসূচি চালু করেছে। 

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভৌগোলিক এবং জলবায়ুগত কারণে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বর্ষাকালে ঘন ঘন বন্যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সেইসঙ্গে ভারী বৃষ্টিজনিত ভূমিধস পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। ফলে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মিশন মৌসমে অগ্রাধিকার দেওয়ায় পার্বত্য ভূখণ্ডে অতিরিক্ত আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। চরম অবস্থার মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভিত্তিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।

পরিশেষে বলতে হয়, আবহাওয়ার খামখেয়ালি প্রকৃতি এবং আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ব্যবস্থা হিসেবে মিশন মৌসম এক রূপান্তরকারী মাইল ফলক রূপে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং যথাযথ ও কার্যকরী তথ্য অংশীদারদের কাছে পৌঁছে দিয়ে এই উদ্যোগ এক সুস্থায়ী উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জীবন-জীবিকা এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোকে রক্ষা করছে।

এই মিশনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত আধুনিকমানের প্রযুক্তি, গবেষণা সমন্বয় এবং জনসচেতনতা প্রচারাভিযানকে অনেক বেশি গ্রহনযোগ্য করে গড়ে তোলা হবে। মিশন মৌসম কেবলমাত্র ঝুঁকি নিরসনেই নয়, বরং জলবায়ুকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের নানা সুযোগ করে দেবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা মহল এবং শিল্প সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মিশন মৌসম ভারতের আবহাওয়া ও জলবায়ু পূর্বাভাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই সঙ্গে এক্ষেত্রে ভারতকে নেতৃত্বের জায়গা করে দেবে। আধুনিক উন্নতমানের প্রযুক্তি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন মডেল এবং সুপার কম্পিউটার ব্যবস্থার মাধ্যমে সময় বেঁধে ও ঋতু ভিত্তিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঠিক নির্ণয় জোগাবে। 

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img