হোমফিচারজমজমাট জামাই ষষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী

জমজমাট জামাই ষষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী

জমজমাট জামাই ষষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী

দেবস্মিতা নাগ
জামাই ষষ্ঠীটা কিন্তু পঞ্চ নয়, প্রায় পঞ্চান্ন ব্যঞ্জনের অনুষ্ঠান। বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের পুজো, পেট পুজোর অনুষ্ঠান এটি। গোড়ায় কিন্তু এমনটা ছিল না। খাওয়া দাওয়া ছাড়াও বেশ কিছু আচার অনুষ্ঠান জড়িত ছিল জামাই ষষ্ঠীর সঙ্গে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যার পরের ষষ্ঠীতেই পালিত হয় জামাইষষ্ঠী। শ্বশুর-শাশুড়ি এই দিন জামাইকে নতুন কাপড় পরিয়ে, ধান-দুব্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে, সকাল সকাল মা ষষ্ঠীর ছবি বা মূর্তিতে পুজো দিয়ে মালসা থেকে ফলাহার করতে দেন জামাইকে। চব্য-চোষ্যটা অবশ্য দুপুরের জন্যে তোলা থাকে।

অনেক এলাকায় আবার চালের গুঁড়ো দিয়ে মূর্তি তৈরি করে মা ষষ্ঠীর পূজা হয়। পূর্ববঙ্গে এখনও মার্জারবাহিনী মা ষষ্ঠীর বিরাট মূর্তি তৈরি করে পূজা হয়। ষষ্ঠী কিন্তু কেবল মাত্র বঙ্গেই নয়, গোটা ভারতের আরাধ্যা দেবী। তিনি সন্তানদাত্রী রূপে সারা ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে পূজিতা। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পূজায় জামাই বাবাজীবন কোথা দিয়ে কী করে ঢুকে পড়লেন? এই প্রশ্নের উত্তর আছে ষষ্ঠীমঙ্গলের লোক কথায়।

কথিত আছে, এক যৌথ পরিবারের ছোট বধূ লুকিয়ে মাছ খেয়ে ফেলতেন। আর রোজই দোষ দিতেন বাড়ির কালো বেড়ালটার উপর। এতে বিড়াল বেজায় চটে গিয়ে ছোট বউয়ের সন্তান চুরি করে জঙ্গলে নিয়ে যায়। ছোট বউ তখন জঙ্গলে গিয়ে দেবী ষষ্ঠীর কঠোর আরাধনা করে সন্তান ফিরে পায়। কিন্তু দেবী এই শর্তেই সন্তান ফেরত দেন যে, বউটি সমাজে তাঁর ও তাঁর বাহন বিড়ালের পূজা প্রচলন করবে। সেই কারণে এই পূজাকে অরণ্যষষ্ঠীও বলা হয়।

সেকালে সন্তানহীনা বধূরা বাপের বাড়ি যেতে পারতেন না। তাঁদের বাপের বাড়ির লোকজনও শ্বশুর বাড়ি এসে তাঁদের সাথে দেখা করতে পারতেন না। নিষিদ্ধ ছিল বেয়াই বাড়ির জলগ্রহণও। সুতরাং যত দিন ছোট বউয়ের সন্তান ছিল না, সে তার বাপের বাড়ি যেতে পারেনি। বহুদিন তার বাপের বাড়ির লোকজনের সাথে তার সাক্ষাৎ-ও হয়নি।ফলে, সন্তান ফিরে আসার পরই বাপের বাড়িতে মেয়ে জামাইয়ের নিমন্ত্রণ হলো। সেই নিমন্ত্রণের ঘটা অনুসরণ করে আজও বাঙালি জামাইদের শ্বশুর বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে পাত পাড়ার ব্যবস্থা হয় ষষ্ঠীর দিনে।

এই অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয় ১৮-১৯ শতকে যখন বাল্য বিবাহ তুঙ্গে। সেই সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাকে দূরে পাঠিয়ে মা বাবা অত্যন্ত চিন্তায় থাকতেন। সারা বছর এই দিনটির জন্যে পথ চেয়ে থাকতেন কবে মেয়ে ফিরবে। মেয়ে জামাই এলে তাদের সন্তান কামনায় বড় করে ষষ্ঠী পূজা দেওয়া হতো, যাতে সন্তান হলে মেয়ের বাপের বাড়ি যখন তখন আসার রাস্তাটা প্রশস্ত হয়।

আজ সমাজের অনেক পালা বদল হয়ে গেছে। কিন্তু ষষ্ঠীর ঘটা পটায় ভাঁটা পড়েনি বিন্দুমাত্র। স্বয়ং করোনাও এই ‘গেট টুগেদার’-এ ব্যাগড়া দিতে পারবে না, যদি মেয়েজামাই কাছাকাছি থাকে। এরকমই এক জামাই ষষ্ঠীতে জন্ম হয়েছিল নবীনবাবুর জামাই ঠকানো বিখ্যাত মিষ্টি জলভরার।

জামাই ষষ্ঠীর পাতে ইলিশ-চিংড়ি-কচি পাঁঠার জায়গা চিরকাল পাকা। বাজার যতই দুর্মূল্য হোক, জামাই ষষ্ঠীর আগের দিন বাজারে গেলে সেটা মনেই হবে না। ঐ দিন পাতে বসার সময় বাঙালি সুগার-প্রেসার-কোলেস্টেরলটা ভুলে যায়। এ সব কথা সেইদিন মুখে আনাও পাপ। করোনার এই বন্দিদশায় বাড়ির ছোটদের কাছে এক পশলা মুক্ত বাতাস এনে দিতে পারে এই অনুষ্ঠান, কারণ এটি নিতান্ত ঘরোয়া একটি উৎসব।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img