সংগ্রাম দত্ত
কাহিনী কিংবদন্তি অনুসারে, চন্দ্রদ্বীপ রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা দনুজমর্দন (আসল নাম রামনাথ দে) তাঁর বন্ধু চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যের সহায়তায় ক্যাতায়নী দেবীর মূর্তি সমুদ্রবক্ষ থেকে উদ্ধার করেন এবং দেবীর আশীর্বাদস্বরূপ চন্দ্রদ্বীপের রাজত্ব লাভ করেন। এ কারণে এই রাজপরিবারে কাত্যায়নী দেবীর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ও কৃতজ্ঞতা রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাধবপাশা কাত্যায়নী মন্দির। মন্দির থেকে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত মূর্তি দুটি এক সময় হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক তৎপরতায় ক্যাতায়নী মূর্তি উদ্ধার করে ঢাকা জাদুঘরে স্থানান্তরিত করা হয়।
এই মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত কিংবদন্তীটি বর্ণনাযোগ্য। বিক্রমপুরের চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য বাল্যকাল থেকে দেবী ক্যাতায়নীর উপাসক ছিলেন। বিয়ের উপযুক্ত হওয়ার পর জনৈকা কন্যা তাঁর জন্য পছন্দ করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কন্যার পিত্রালয়ে উপস্থিত হওয়ার পর চন্দ্রশেখর তাঁর হবু পত্নীর নাম ভুবনেশ্বরী জেনে তাঁকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন এবং বিয়ে বাসর থেকে পলায়ন করে। আরাধ্য দেবীর সঙ্গে হবু স্ত্রীর নামের মিল তাঁর কাছে জন্য লজ্জাজনক বলে মনে হয় এবং সমুদ্রে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ক্ষুদ্রাকার একটি নৌকায় আরোহণ করেন।
পথিমধ্যে হঠাৎ জনৈকা তরুণী তাঁকে আত্মহত্যার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বলায় চন্দ্রশেখর বিস্মিত হন। ঘোর কেটে যাওয়ার পর তিনি কন্যার পরিচয় এবং তাঁকে প্রাণ বিসর্জনে বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চান। তরুণী চন্দ্রশেখরের কাছে নিজেকে একজন জেলে কন্যা হিসেবে পরিচয় দেয় এবং বলেন যে, স্ত্রীলোক মাত্রই ক্যাতায়নীর অংশ। অতএব তার নামে হবু স্ত্রীর নাম থাকা দোষণীয় কোনো ব্যাপার নয়। এই কথায় চন্দ্রশেখর ঐ তরুণীর পরিচয় জানার জন্য ভীষণ রকমের উদগ্রীব হয়ে পড়েন এবং জানতে না পারলে আত্মহত্যার হুমকি দেন। তরুণী রূপধারী ক্যাতায়নী দেবী তখন আত্মপরিচয় দিয়ে চন্দ্রশেখরকে আত্মহননের পথ থেকে নিবৃত্ত করেন এবং তাঁকে ঐ কন্যার নাম পরিবর্তন করে বিয়ে করার পরামর্শ দেযন।
এছাড়া দেবী তাঁকে অতি শীঘ্র সুগন্ধা নদীর মোহনায় একটি বিশাল দ্বীপের মতো ভূ-খণ্ড উত্থিত হওয়ার কথা এবং সেই ভূখণ্ড তাঁর নামানুসারে পরিচিত হবে বলে জানায়। দেবী আরো বলেন যে, চন্দ্রশেখর যেন সেই সুগন্ধা নদীতে ডুব দিয়ে ক্যাতায়নী এবং মদন গোপালের মূর্তি উত্তোলন করেন এবং সেখানে তাঁর রাজত্ব স্থাপন করেন। দেবীর আদেশ মতো চন্দ্রশেখর তার হবু পত্নীর নাম পরিবর্তন করে তাকে বিয়ে করে এবং নির্দিষ্ট দিন এবং স্থানে ডুব দিয়ে মূর্তি উদ্ধার করে সে তার প্রিয় সঙ্গী দনুজমর্দনসহ ক্রমশঃ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে দেবী কথিত দ্বীপে রাজত্ব স্থাপন করেন।
কাত্যায়নীর এই মূর্তিটি অষ্ট হস্তবিশিষ্ট। কৃষ্ণ পাথরের মূর্তি মহিষমর্দিনীর অষ্ট হস্তের বিবরণ : ১. চক্র, ২. অসূরের বুকে নিক্ষিপ্ত ত্রিশূল, ৩. তূণ থেকে তোলা তীর ৪. তরবারী ৫. তর্জনী মুদ্রা ৬. ঢাল, ৭. ধনুক এবং ৮. অসূরের চুল। কাত্যায়নী মূর্তিটি দশ অথবা এগারো শতকে নির্মিত বলে মনে হয়।
বরিশালের মাধবপাশায় কাত্যায়নী মন্দির তীর্থস্থান হিসেবে বিখ্যাত ছিল। একসময়কার মাধবপাশায় সংরক্ষিত ছিল কাত্যায়নী দেবীর মূর্তি। বর্তমানে ঐ মূর্তিটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
বরিশালের প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ। এটি বাংলার আদি জনপদের একটি। এক সময় মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল বংশের শাসনে ছিল। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমি যে মানচিত্র তৈরি করেন, তাতে চন্দ্রদ্বীপের স্থলভাগ দেখা যায়। তখন গঙ্গা নদীর শাখা সিওডোস্টমনের মোহনায় বেশ কয়েকটি দ্বীপের সমাহার ছিল চন্দ্রদ্বীপ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রিক বিবরণে দেখা যায়, গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্র।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে চন্দ্রদ্বীপ একটি জনপদ ছিল। সুতরাং চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস খুবই প্রাচীন এবং এর ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগে হয়েছে।