ড. বিকাশ পাল, লন্ডন প্রবাসী গবেষক-অধ্যাপক
বহু সাধকের
বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার
মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে
অসীমের লীলা পথে
নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯৩৬ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ভগবান পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবের শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনের একটা পর্বে রবীন্দ্রনাথ সভাপতির যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি রামকৃষ্ণ দেবের উদ্দেশ্যে তাঁর লেখা এই কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইংলান্ডের দার্শনিক Sir Francis Younghusband সেদিন সেই পর্বের শেষে তাঁর ধন্যবাদ জ্ঞাপনে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা বললেন, তার পর যদি সম্মেলনের বাকি কোনও কিছুই না থাকত, তাতেও তাঁদের এই ধর্মমহাসভা সাফল্যমন্ডিত হত।
রবীন্দ্রনাথ সেই মহূর্তে শুধু ভারতবর্ষ কেন, এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি কোনওদিন ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করেননি। ধর্ম থেকে দূরে থাকতেন। কিন্তু এই একমাত্র একটি মানুষকে তিনি এত শ্রদ্ধা আর ভক্তি করতেন যে, অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করার অনুরোধ প্রত্যাখান করেননি। ধর্মনৈতিক ধ্বংসবাদের যুগে রামকৃষ্ণদেব মানুষকে তাঁদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে উপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছেন তাঁর সহজ সরল ভাষায়। তাঁর সেই উপলব্ধি কেবল ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা আর সত্যের উপর ভিত্তি করেই হয়েছিল। তিনি সব কিছু দিতে রাজি, কিন্তু কখনও সত্যকে দিতে রাজি ছিলেন না, একথা আমরা কথামৃতে পড়েছি।
আমার ধারণা, এই সত্যের প্রতি অবিচল এক জন সহজ সরল মানুষ তাই হয়ত রবীন্দ্রনাথের বিবেচনায় সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। সেজন্যই তিনি তাঁর নামাঙ্কিত শতবার্ষিকী মহাসভায় নির্দ্বিধায় বক্তব্য রাখতে সম্মত হন।
কথামৃত আর শঙ্করীপ্রসাদ বসুর গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৮৮৩ সালের ২ মে, উত্তর কলকাতার নন্দন বাগানে আদি ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সভায় কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে পিয়ানো বাজিয়ে গান শোনান। রামকৃষ্ণদেব খুব আনন্দ পান আর যুবক রবীন্দ্রনাথের বেশ প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথের তখন ২২ বছর বয়স।
সেদিন ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরে ফেরার সময় গাড়ি ভাড়া হিসেবে তিন টাকা দু আনা ঠিক হয়। কাশীশ্বর মিত্রের পরিবারের কেউ তিন টাকা দিয়ে বলেন, এতেই হবে। গাড়ি ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেও দেয়। তবে এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ যখনই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যেতেন, তাঁরা ঠাকুরের শয়ন কক্ষের প্রণামী বাক্সে সেই তাঁদের পূর্বপুরুষদের না দেওয়া দু আনা দিয়ে যেতেন।
১৮ ফেব্রুয়ারি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আবির্ভাবের দিন। জন্মদিন বললাম না, কেন না ঈশ্বরের কোনও জন্ম-মৃত্যু হয় না। তাঁর আবির্ভাব আর তিরোভাব হয়। “তোমাদের চৈতন্য হউক”, ঠাকুরের এই আশীর্বাদ যেন আমাদের উপর বর্ষিত হয়, সকলের জন্য এই প্রার্থনা করছি।