শ্যামল সান্যাল: চিনে খাবারে বাঙালি মজে আছে বহু দিন। চায়না টাউনের সব রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যায় কলকাতার মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। সকালে লালবাজারের পেছনে চিনে মোমো গরম গরম খেতে বহু ফুডির গাড়ি থামে।
মেনল্যান্ড চায়না – এই শহরের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের কথা খাদ্যরসিকদের অজানা নয়।
সীমান্তে দু পক্ষের গোলাগুলির সঙ্গে এই শহরের চিনেদের কোনও সম্পর্কই নেই। এদের পাঁচ পুরুষ কোনও দিন চিনে যাননি। কলকাতার জন্মের সময় থেকেই এঁরা আছেন। ক্যান্টনি ভাষায় কথা বলেন , হিন্দি, ইংরেজিও বলেন। কালীপুজোর মন্দির আছে ট্যাংরার চিনে পাড়ায়।
চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের সঙ্গে মিটিং করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওদেশে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি। চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। চিনে গিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন চিনা ভবন। দু দেশের সাংস্কৃতিক আদান প্রদান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের হাতেই। সেই চিনা ভবনে আজ দুদেশের বহু ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা করেন। এখানকার অনেক ছাত্রছাত্রী চিনে আছেন, তেমনই চিনের অনেক ছাত্র ছাত্রী শান্তিনিকেতনে আছেন। দিব্বি বাংলা বলেন, বাউলদের সঙ্গে গানে গলা মিলিয়ে গান ধরেন..তোমায় আমায় মিলন হবে কবে..।
চিনের সঙ্গে ভারতের মিলন, বাস্তবে দূর অস্ত ।ঐতিহাসিক কারণেই দুদেশের ভেতরে ওপর ওপর ভালোবাসা, হিন্দি চিনি ভাই ভাই , ওই পর্যন্ত। পন্ডিত নেহরুর সময় থেকে মোদী পর্যন্ত চিনের সঙ্গে খটাখটি লেগেই আছে। যুদ্ধও হয়েছে। তার ফলাফল জানা আছে মোদী সরকারের।এখনকার পরিস্থিতিতে তিনি গরম কথা বলেছেন, চিনকে হুমকি দিয়েছেন। চিনের ওপরে নির্ভরতা কমিয়ে অন্য রাস্তা দেখার কথাও বলেছেন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের নজর কিন্তু রাশিয়ার মধ্যস্ততায় বৈঠকের দিকেই। চিনের শি জিংপিং ও মোদীর সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এই বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। কারণ রাশিয়া ভারতের পুরনো বন্ধু। নানা বিপদে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। চিনের সঙ্গেও এখন তাঁদের খুবই ভালো সম্পর্ক।
রাশিয়া, চিন, দুই দেশ বরাবরই আমেরিকা বিরোধী। এই দুই দেশেরই ভারতের সঙ্গে আমেরিকার এত মাখামাখি বিলকুল না পসন্দ। এর পেছনে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আছে বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দুই দেশই ভারতের বাজার চায়। চিনের ব্যবসা এদেশে কমার ইঙ্গিত আছে। রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র, চিনের তো প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা ভারতে।
এখানে পরিষ্কার বাণিজ্যের যুদ্ধ। আমেরিকার সঙ্গে চিনের এই যুদ্ধের ফলে চৈনিক বাণিজ্য মার খেয়েছে। ভারতের বাজারেও যাতে মার খেতে না হয়, সেটার হিসেব ঠিক করতেই চিন ভারতের সীমানায় হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া নিজের ব্যবসার সঙ্গে চিনের বাণিজ্যটাও যাতে ঠিক চলে সেই ব্যবস্থা করতে চাইছে। আমেরিকার কবল থেকে ভারতকে সরিয়ে আনাই হল লক্ষ্য। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন , তিন দেশের এই বৈঠকে শেষ পর্যন্ত বরফ গলবে।
এদিকে, একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের দিকেও তাঁরা নজর রাখছেন।
এক: এবারের কলকাতা বই মেলায় প্রথমবার রাশিয়া বিশাল প্যাভিলিয়ন করেছিল। খোদ মস্কো থেকে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অফিসারের দল রোজ ওই স্টলে ছিলেন।মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাশিয়ার মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন মুখমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। চিনের কেউ আসেনি, স্টলও করেনি।
দুই : মমতা ব্যানার্জি চিনে যাবার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পরও তিনি যাননি।
তিন : কলকাতার চিনা দূতাবাসে কত চিনা কর্মী আছেন, সে বিষয়ে গোয়েন্দারা খোঁজ রাখেন। এঁরা নানা ভাবে সমাজের বিভিন্ন অংশের ভেতরে ঢুকে কি করছেন, সেদিকেও গোয়েন্দা রিপোর্টের সঙ্গে চাঞ্চল্যকর খবর আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে।
নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষদের মতে, আগামী দিনে চিন, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বদলে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।