হোমআজকের সেরা খবরকফি হাউস ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কফি হাউস ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কফি হাউস ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কিন্নর রায়, বিশিষ্ট সাহিত্যিক

ওই তো কোণের টেবিলে উনি ও নির্মাল্য আচার্য্য বসে। পত্রিকার এডিটিং, প্রুফ দেখার কাজে ব্যস্ত।সেই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা “এক্ষণ”। তার প্রচ্ছদ করেছেন সত্যজিৎ রায়।

সৌমিত্রবাবুর দেবদুতের মত চেহারা । এক মাথা অবিন্যস্ত চুল। ছিপ ছিপে, লম্বা ফর্সা মানুষটি পরের পর হলদে প্যাকেট থেকে চার্মিনার ধরাচ্ছেন, সঙ্গে কালো কফি। খদ্দরের পাঞ্জাবি, পাতলুন, চপ্পল, একটা কাঁধে ঝোলা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। নির্মাল্য বাবু ও তিনি সেই পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। আমরা কয়েকজন অন্য টেবিল থেকে অত্যন্ত বিস্ময় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম ওঁদের।

সময়কাল ৬৯-৭০। উত্তাল রাজনৈতিক আবহ। সবে সিপিআইএমএল দলের জন্ম হয়েছে। নকশালবাড়ি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের মত কিছু যুবক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। প্রেসিডেন্সি কলেজ ঘিরে সে আন্দোলন। অসীম চ্যাটার্জিরা আমাদের সঙ্গে ওই কফি হাউসের অন্য টেবিলে বসতেন। আমরা বিপ্লবী কাজকর্ম নিয়ে ওঁদের কথা শুনতাম, বলতাম।

সেও এক আড্ডা। একটু দূরেই ভবানী দত্ত লেনে বোমা পড়ার আওয়াজ আসছে। কিন্তু সৌমিত্রবাবুদের সে বিষয়ে ভ্রূক্ষেপের ব্যাপার ছিল না । বাম মানসিকতার মানুষটি সেসব সহজভাবেই নিতেন। ওঁদের টেবিলে মাঝে সাঝে অসীম গিয়ে একটু আড্ডা মেরে আসতেন। কিন্তু আমি যাইনি। কারণ, তিনি তখনই স্টার।

“ঝিন্দের বন্দী” সিনেমাটি হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। আমাদের মত বাম মানসিকতার ছেলেমেয়েদের কাছে হিরো তো উনিই। উত্তমকুমার নন। ওঁদের টেবিলে তাঁর ভক্তদের কেউ কেউ যেতেন অটোগ্রাফ নিতে। সুন্দরীরা যেতেন বেশি। দূরের টেবিল থেকে ওঁকে দেখতে দেখতে তাঁদের কফি ঠান্ডা হয়ে যেত।

সৌমিত্রবাবুকে সেই সময় থেকে দেখে আসছি। ওঁর অভিনয় দেখেছি, স্টেজে ও পর্দায়। ওনার লেখা গদ্য ও কবিতার একজন পাঠক হিসেবে বলতে পারি, কবিতায় অনেক সময় তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ছাপিয়ে গেছেন। অসাধারণ গদ্য লিখেছেন, নাটক লিখেছেন। দুরন্ত অভিনয় তো করেইছেন। তিনি ক্রিকেট এবং ব্যাডমিন্টন খেলতেন দারুণ। আবার বন্যা বা কোনোও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে ত্রাণের জন্য বামেদের মিছিলে পা মিলিয়েছেন।

বাম মানসিকতার মানুষটি নানা বিষয়ে অগাধ পড়াশোনা করতেন। কবি সাহিত্যিক সঙ্গীত বা চিত্র শিল্পীরা তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন বরাবর। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর সঙ্গী। কবিতা পাঠ, আবৃত্তি বা গদ্য পাঠ, তিনি যে কতবড় শিল্প সে কথা তিনিই সম্ভবত প্রথম বুঝিয়েছিলেন। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র , কাজী সব্যসাচীর কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, সৌমিত্র ছিলেন ব্যতিক্রম। ওঁর উচ্চারণ, শব্দক্ষেপ, মডুলেশনের তুলনা হয় না।

অভিনেতা হিসেবে পৃথিবীর সেরাদের একজন ছিলেন তিনি নিশ্চয়ই। ফরাসি পুরস্কার লিজিয়ঁ দ্য অনার তিনি পেয়েছেন, তাঁর বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের মতই। দেশ-বিদেশের অজস্র স্বীকৃতি সেই ঝোলায় এসেছে।

কিন্তু কবি সাহিত্যিক হিসেবে তেমন সম্মান বা স্বীকৃতি তিনি পান নি। অথচ এটা অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য ছিল। বুদ্ধি দিয়ে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সৌমিত্রবাবুর জুড়ি খুবই কম। ওঁকে সেলিব্রিটি অ্যাক্টর বলা যায়। তিনি সত্যজিৎবাবু ছাড়াও অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। নাটকে নির্দেশকের ভূমিকায় কয়েকবার তাঁকে দেখা গেলেও ফিল্মে তিনি অভিনেতাই রয়ে গিয়েছেন শেষ দিন পর্যন্ত।

খুবই দুর্বল অনেক ফিল্মে উনি অভিনয় করেছেন। সস্তার বিজ্ঞাপনে মুখ দেখিয়েছেন এই অসাধারণ অভিনেতা বাধ্য হয়ে। কারণ তিনিই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না তিনি। বিস্মিত হই ভাবতে, ওনার মত প্রতিভাকেও কেন এই যন্ত্রণা পেতে হলো..!

এত কষ্টের ভেতরেও তিনি ভাবতেন ভালো অভিনয়ের কথা। চমৎকার লেখার কথা। তাঁর প্রাণশক্তি ছিল অফুরান। শেষ পর্যন্তও তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে সরে যাননি। সব দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যাযের আত্মার শান্তি কামনা করি। যেখানেই থাকুন না কেন, ভালো থাকবেন আপনি।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img