ডা. পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার
বিশ্বভুবনের অপরূপ ছবি মনের মধ্যে ধরে রাখবার জন্য শরীরের যে অঙ্গটির একান্ত প্রয়োজন সেটি হল, আমাদের চোখ বা চক্ষুরত্ন। অত্যাশ্চর্য এই ছোট্টো যন্ত্রটির সাহায্যেই আমরা দেখতে পাই আমাদের চারপাশের জগতটাকে। আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, পড়াশোনা, খেলাধূলা সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সুস্থ চোখের মাধ্যমে। সেই চোখ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার কর্মক্ষমতা কমে যায়, দেখতে অসুবিধা হয়, তখন রোজকার কাজকর্মে নানা সমস্যা দেখা দেয়। আমরা চক্ষু চিকিৎসকের কাছে যাই, তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চশমা পরে নিশ্চিন্ত হই। ফিরে পাই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।
এই সুবিধা কিন্তু পুরনো কালের লোকেরা উপভোগ করতে পারতেন না। ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দের আগে পর্যন্ত ক্ষীণদৃষ্টি লোকেদের পড়াশোনা করা বা দূরের জিনিস দেখতে খুবই অসুবিধা হত, কারণ তখন চশমার কোনো ধারণাই ছিল না। ভারত, চিন, গ্রিক, ইজিপ্ট ইত্যাদি দেশের অসাধারণ পণ্ডিতদের বয়সজনিত কারণে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেলে, তাঁরা বড়ই অসহায় হয়ে পড়তেন। অনেকেরই কম বয়সী লোকেদের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনার কাজ চালাতে হত।
কাচের বয়ামে রঙিন মাছেদের আকারে বড় দেখায়। সেটা দেখে, লেখার উপরে জলভর্তি কাঁচের পাত্র রেখে তাঁরা পড়ার চেষ্টা করতেন। আবার বাইরের কাজের সময় প্রখর রোদের ঝলকানি বা গ্লেয়ার থেকে চোখকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা আড়াআড়ি ভাবে চেরা হাতির দাঁতের টুকরো চোখের সামনে ধরে রাখতেন। সেটা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীর আগের কথা। শোনা যায় রাজা নীরো চোখের সামনে পালিশ করা পান্না রেখে তার সৈন্যদের যুদ্ধ দেখতেন।
চশমা কবে আবিষ্কৃত হয়েছিল, কে বা তার আবিষ্কারক, সে তথ্য সঠিকভাবে এখনো জানা যায়নি। অনুমান করা হয় ইতালিতে 1268 থেকে 1290 সালের মধ্যে প্রথম চশমার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। অবশ্য সেগুলি এখনকার চশমার মত ছিল না। কেবলমাত্র পুরোহিত বা গবেষকরাই একটুকরো উত্তল-কাচ (আসলে ম্যাগনিফাইং গ্লাস) চোখের সামনে ধরে পড়াশুনার কাজ চালাতেন। এগুলিকে বলা হত রিডিংস্টোন (Reading Stone)। ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও রিডিংস্টোন ব্যবহার হতে দেখা যায় ।
এই রিডিংস্টোনের ধারণা থেকেই চশমায় কাচের (Glass) ব্যবহার শুরু হয়েছিল। প্রায় 4000 বছর আগে মেসোপটেমিয়া এবং রোমে প্রথম কাচ তৈরির কথা শোনা যায়। তারপরে বহু শতাব্দীর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে আধুনিক কাঁচ তৈরির পদ্ধতি মানুষের করায়ত্ত হল। স্পেনের গণিত বিজ্ঞানী Abu Ali Hasan Bin Al-Haitam (সংক্ষেপে Alhazen) একাদশ শতাব্দীতে কাচের প্রতিসরণ (Refraction), বিবর্ধন (Magnification) ইত্যাদি গুণগুলির তত্ত্ব প্রচার করেন। সেই তত্ত্ব অনুসারেই লেখাপড়া কিম্বা কাছের জিনিস ভালোভাবে দেখবার জন্য কাচের উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হত।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে অবতল লেন্স (Concave Lens) আবিষ্কার এবং 1451 সালে দেখার কাজে এই লেন্সের ব্যবহার শুরু হলে দূরে দেখার সমস্যারও কিছুটা সমাধান হল। ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী Thomas Young 1801 খৃষ্টাব্দে প্রথম চোখের অ্যাস্টিগমাটিজমের তত্ত্ব প্রচার করেন। এরপরে ইংলন্ডের জ্যোর্তিবিজ্ঞানী Sir George Biddle Airy 1827 সালে অ্যাস্টিগমাটিজম চিকিৎসার জন্য সিলিণ্ড্রিকাল লেন্স আবিষ্কার করেন। অবশ্য এই সমস্ত লেন্সগুলি চোখের সামনে হাতে ধরে ব্যবহার করতে হত।
দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চিন দেশের বিচারকেরা ধূসর রঙের এক বিশেষ ধরনের ক্যোয়ার্জ ক্রিস্টালের চশমা পরে মুখের অভিব্যক্তিকে আড়াল করতেন। তখন এক চক্ষু চশমা (Monocle) খুবই জনপ্রিয় ছিল, বিশেষত সম্ভ্রান্ত লোকেদের মধ্যে। একটি গোলাকার উত্তল লেন্সের প্রান্তের দিকটি ধাতব রিং বা তার দিয়ে ঘিরে রাখা হত। এই রিং-এর যুক্ত এক খণ্ড দড়ি ব্যবহারকারীর পোশাকের সঙ্গে আটকানো থাকত। লেন্সযুক্ত ধাতব রিংটি চোখের কোঠরে চেপে ধরে এক চোখ দিয়ে কাছের সূক্ষ জিনিস দেখা যেত।
কিন্তু তখনও পর্যন্ত চশমার ফ্রেম আবিষ্কার হয়নি, ফলে কাচগুলিকে চোখের সামনে ধরে রাখা সম্ভব হত না। স্পেনের লোকেরা চশমার কাঁচগুলিকে সিল্কের দড়ির সাহায্যে কানের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। চিনের চশমা ব্যবহারকারীরা সিল্কের দড়ির একপ্রান্তে সামান্য ভারি জিনিস বেঁধে কাচটিকে কানের থেকে ঝুলিয়ে রাখতেন। 1730 খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের বিজ্ঞানী Edward Scarlett কানের উপর বসানো দুটি ধাতব দণ্ডের সাহায্যে চশমার কাচগুলিকে মুখের সামনে ধরে রাখবার ব্যবস্থা করলেন। এটাই সম্ভবত চশমার ফ্রেম আবিষ্কারের প্রথম ধাপ।
তার প্রায় 22 বছর পরে 1752 খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনের আর এক বিজ্ঞানী James Ayscough ডিজাইনের সামান্য পরিবর্তন করে কব্জাযুক্ত ফ্রেম প্রচলন করলেন যেগুলি ভাঁজ করে রাখা যায়। তিনি মনে করতেন স্বচ্ছ কাচের বদলে হালকা নীল বা সবুজ কাচ ব্যবহার করলে দৃষ্টির বেশী উন্নতি হয়। এই ধারণা থেকেই এখনকার সানগ্লাস বা রোদ চশমা আবিষ্কার হয়েছে।
সেই সময়ে এই ধরনের চশমা পদমর্যাদার প্রতীক হিসাবে গণ্য হত। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও চিত্রতারকারাই প্রধানত চশমা ব্যবহার করতেন। তাদের অনুকরণে ধীরে ধীরে জনসাধারণের মধ্যেও চশমার প্রচলন বৃদ্ধি পেল। 1799 সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় John McAllister প্রথম চশমার দোকান স্থাপন করেন। তার আগে কেবলমাত্র ফেরিওয়ালাদের কাছেই চশমা পাওয়া যেত। McAllister নিজেরাই নানা ধরনের চশমার ফ্রেম তৈরি করতেন। 1828 সাল থেকে তাঁরা চশমায় সিলিণ্ড্রিকাল লেন্সের ব্যবহার শুরু করেন।
এরপরে বাইফোকাল কাচের আবিষ্কার চশমার জগতে আলোড়ন ফেলে দিল। কিছু বিতর্ক থাকলেও মনে করা হয় আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী Benjamin Franklin (1706-1790) 1784 খ্রিস্টাব্দে বাইফোকাল লেন্স আবিষ্কার করেন। সেই সময়ে দুটি আলাদা লেন্স (একটা দূরের ও অন্যটা কাছের দেখবার জন্য) একটা ধাতব ফ্রেমে আটকানো থাকতো। 1899 সালে J.L. Borsch দুটি লেন্সকে একত্রে জোড়া দেবার ব্যবস্থা করলেন।
1910 খ্রিস্টাব্দে Benton and Emerson এক-কাচের বাইফোকাল (One-part Bifocal) লেন্স তৈরি করলেন। উপরিউক্ত সমস্ত বাইফোকাল গুলিতে কাচদুটির জোড়া অংশে স্পষ্ট দাগ থাকত। তারপরে 1955 সালে Irving Rips দাগহীন বাইফোকাল লেন্স প্রচলন করলেন। এই প্রযুক্তিতেই বর্তমানের প্রোগ্রেসিভ লেন্স তৈরি হয়েছে।
1929 সালে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষাকারী পোলারাইজ (Polarize) লেন্স আবিষ্কারের পরেই সানগ্লাস বা রোদ চশমা জনপ্রিয় হতে শুরু করল। 1862 সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী Alexander Parkes প্রাকৃতিক সেলুলোজ থেকে কৃত্রিম প্লাস্টিক তৈরি করেন। এর পরে আমেরিকান বিজ্ঞানী Leo Baekeland 1907 সালে কৃত্রিম উপায়ে আধুনিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন।
আজকাল বেশিরভাগ চশমার লেন্সই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। কারণ এগুলি খুব হালকা হয় আর সহজে ভেঙে যায় না। 1960 সালে Roger Araujo ফটোক্রোমাটিক লেন্স আবিষ্কার করলেন। এগুলি সূর্য্যের আলোয় সানগ্লাসের মত ধূসর কিন্তু ছায়াতে স্বচ্ছ হয়ে যায়। 1990 সালে প্লাস্টিকের ফটোক্রোমাটিক লেন্সের প্রচলন হল। সারা পৃথিবীতে চশমা ব্যবহারকারীর সংখ্যা যত বাড়ছে, চশমার ফ্রেম ও লেন্স ততই উন্নত, ফ্যাশানদুরস্ত আর আরামদায়ক হয়ে উঠছে প্রতিদিন।
চশমা এখন আর শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় উপকরণই নয়, আধুনিক ফ্যাশানের অন্যতম হাতিয়ার। নিজের সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে চশমার জুড়ি নেই। প্রথম প্রচলনের পর থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের চাহিদা অনুযায়ী চশমার ফ্রেম ও তার ডিজাইনের অনবরত পরিবর্তন হয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন আর চশমার দুনিয়ায় নতুন নতুন আবিষ্কার চলতেই থাকবে।