(আফগানিস্তানে ৩ লক্ষ সেনার ট্রেনিং ও অস্ত্র জোগাতে আমেরিকা খরচ করেছে ৮৪০ কোটি ডলার। গত দু’দশকে খরচ ২ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। তবু কাবুলে উড়ল তালিবানের পতাকা। সাংবাদিক সুচিক্কণ দাসের কলম।)
যেভাবে ব্লিৎসক্রিগের গতিতে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ১০ দিনের মধ্যে কাবুল শহর দখল করে আফগানিস্তানে (Afghanistan) নিজেদের রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল তালিবান (Taliban), তাতে প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে এত সহজে জয় পেল তালিবান? এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে অনুমান করার কারণ আছে যে, আফগানিস্তান শাসনের ভার আসলে তালিবানের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। সম্ভবত অর্থনৈতিকভাবে আফগান যুদ্ধের ভার বহনের ক্ষমতা আর ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এর ওপর বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসায় অন্য সমস্যা ঝেড়ে ফেলে নিজেদের অর্থনীতিকে ফের সংহত করতে চাইছে মার্কিন ডিপ স্টেট। সেকারণেই সম্ভবত আফগানিস্তানের দায় এড়াতে চায় বাইডেন প্রশাসন।
বাইডেন (Joe Biden) প্রশাসন এ কথা স্বীকার করেছে যে, আফগানিস্তানে ৩ লক্ষ সেনা ও পুলিশকর্মীদের ট্রেনিং দিতে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র–সহ সরঞ্জাম জোগাতে আমেরিকা এ পর্যন্ত খরচ করেছে কম করেও ৮৪০ কোটি ডলার। গত দু’দশকে আফগানিস্তানে খরচ হয়েছে ২ লক্ষ কোটি ডলারের বেশি। তবু তালিবানকে কায়দা করা যায়নি। এখন আবার কোভিডে বিপর্যস্ত আমেরিকার পক্ষে এখন আর এই খরচ আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না । একই কারণে ইরাক থেকে সেনা সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ট্রাম্প।
আবার ন্যাটোর বাহিনী পুষতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি তাদের প্রতিশ্রুতি মতো টাকা না দেওয়ায়, আমেরিকার ঘাড়ে বিপুল অর্থ জোগানের চাপ বেড়েছিল। সে কারণে ন্যাটো থেকেও সেনা সরিয়ে খরচ কমিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। সব মিলিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীর দেশে দেশে মার্কিন–বিরোধী শক্তিকে ঠেকাতে বিশ্ব–পুলিশের যে ভূমিকা পালন করে আসছিল আমেরিকা, এখন ধাপে ধাপে তারা সেই ভূমিকা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। এটা মার্কিন বিদেশনীতির স্ট্র্যাটেজিক শিফট যা শুরু হয়েছে অনেক আগে এবং তালিবানের হাতে আফগানিস্তানকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভবত সেই রণকৌশলেরই একটা পর্ব।
তালিবান ক্ষমতায় এলে আফগান মহিলাদের কী হবে, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেই সংবাদ সংস্থা সিবিএসকে বাইডেন বলেছিলেন, “আমার কি কোনও দায় আছে? একেবারেই নেই। আমার একমাত্র দায় হল মার্কিন জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা এবং পৃথিবীর সব সমস্যা গায়ের জোরে সমাধান করতে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের যাতে কোনও ক্ষতির মুখে পড়তে না হয় সেটা দেখা।”(সূত্র: ১৫ আগস্ট টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হেনিনগান ও কিম্বারলি ডোজিয়ারের নিবন্ধ)। আফগানিস্তান ও তালিবান নিয়ে আমেরিকার অবস্থান বাইডেনের এই উক্তি থেকেই স্পষ্ট।
তালিবানের মোট বাহিনী আনুমানিক ৭৫ হাজার। তাও নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়। উল্টোদিকে মার্কিন সহায়তাপুষ্ট আফগান সরকারের সেনা ও পুলিশের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষের বেশি। এরা কেন তালিবানকে বাধা দিল না ? কারণ, এই সব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশের কমান্ডাররা আসলে মার্কিন সেনাকর্তাদের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মার্কিন সেনাকর্তাদের মারফতই এই কমান্ডাররা আগাম জানতেন যে, গনি সরকারের পিছনে আর আমেরিকা নেই। আছে তালিবানের পিছনে। যারা দেশের ভবিষ্যৎ শাসক, তাদের সঙ্গে কেই–বা যেচে ঝগড়া করতে চায়।
তাই প্রায় সমস্ত প্রদেশে সরকারি সেনারা ব্যক্তিগত ভাবে, গোটা ইউনিট এবং এমনকী গোটা ডিভিশন তালিবানের পক্ষে চলে গেছে বলে খবর এসেছে। এদের কাছ থেকেই গাড়ি, ডিজেল এবং যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে (যেটা আবার সরবরাহ করেছিল আমেরিকাই) ঝড়ের গতিতে সব প্রাদেশিক রাজধানী ও শেষে কাবুল দখল করেছে তালিবান। এখন এসব দেখে বাইডেন প্রশাসন যে বিস্ময় প্রকাশ করছে সেটাই আশ্চর্যের।
তালিবান জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তানে ইসলামিক আমিরশাহি প্রতিষ্ঠা করবে। সেই ইসলামি শাসন কি আগের মতো কট্টর, ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী আফগানিস্তান গড়বে? প্রশ্রয় দেবে কি মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদে এবং ফের চাঙ্গা করবে আল কায়দাকে? এই আশঙ্কাতেই উদ্বিগ্ন সারা বিশ্ব। এমনটা হলে আফগানিস্তান থেকে গোটা মধ্য এশিয়া (তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাকস্তান), চীনের (China) সংখ্যালঘু উইঘুর এলাকা, রাশিয়ার (Russia) চেচনিয়ায় ফের মাথাচাড়া দেবে ইসলামি মৌলবাদ তথা সন্ত্রাসবাদ। নতুন করে ইরাকে ও সিরিয়ায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করবে আইসিস বা আল কায়দা। মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে ইরান ও তুরস্ক সীমান্তেও। এর মানে যারা আমেরিকার শত্রু, সেই চীন, রাশিয়া ও ইরান নতুন করে তালিবান–মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, যেটা আমেরিকার পক্ষে অ্যাডভান্টেজ।
আফগানিস্তানকে নিয়ে মার্কিন ডিপ স্টেটের এমন রাজনৈতিক কৌশল যে একেবারে নেই, একথা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিলে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপও তার আঁচ থেকে রেহাই পাবে না। কারণ ৯/১১–র পরবর্তী ঘটনা ও লাদেন হত্যার স্মৃতি মৌলবাদী, পুনর্জীবিত তালিবানকে তাড়া করে বেড়াতে পারে।
সে কারণে তালিবানকে বেঁধে রাখতে তিনটে শর্ত চাপানো হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। কাবুলে ক্ষমতাসীন তালিবান সন্ত্রাসবাদ, আল কায়দা ও মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিলে, কাবুলের ভাবী শাসক হিসেবে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে না। এমন আভাস তালিবানকে আগেই দেওয়া হয়েছে। তখন দরকারে রাষ্ট্রপুঞ্জ বহুদেশীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠিয়ে তালিবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে পারে। আরও একটা সম্ভাবনা এখনই খারিজ করা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে তালিবানই নিজেকে বদলে ফেলতে পারে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও অর্থসাহায্য। এগুলো পেতে গেলে আন্তর্জাতিক শক্তিজোটের শর্ত কিছুটা হলেও মানতে হবে। ফলে আংশিক ইনক্লুসিভ সরকার গড়ার পথের কথা বলতে পারে তালিবান। হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে তালিবানের বৈঠক কি তারই ইঙ্গিত?
এখনকার বিশ্বে, আন্তর্জাতিক মহল থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই ধর্ম বনাম যুগধর্ম পালনের সঙ্ঘাতে পড়তে পারে তালিবান। এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব তালিবানকে প্রভাবিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে আফগানিস্তান হতে পারে পশ্চিম এশিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের আদলে কোনও দেশ। যদিও ঘোষিতভাবে ইসলামিক আমিরশাহির মতো একটা দেশ কীভাবে ইনক্লুসিভ সমাজ গড়বে তা বোঝা মুশকিল। কারণ, আফগানিস্তানের উপজাতিভিত্তিক সমাজে ধর্ম ও পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাধান্য সীমাহীন।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তানকে ঘিরে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের জয়ের সাফল্যকে হাতিয়ার করে তালিবান যদি কট্টরপন্থী ইসলামি শাসনে ফিরে যায়, তাহলে সে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয়, লিবারাল গোষ্ঠীর লোকজন এবং সাধারণভাবে মহিলারা নতুন করে ধর্মীয় ও পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের শিকার হবেন। সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যের। এবং একইসঙ্গে ফের পঞ্জশিরের কন্দরে কন্দরে তালিবান বিরোধী আফগান সেনাদের নিয়ে ছোট ছোট প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠতে পারে।
সেক্ষেত্রে আফগানিস্তানে শুরু হবে গৃহযুদ্ধের এক নতুন পর্যায়। আর তালিবান যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতির লক্ষ্মণরেখা মেনে দেশ পুনর্গঠনে মন দেয়, তাহলে সেখানে অন্য ভূমিকায় দেখা যেতে পারে চীন ও রাশিয়াকে। তখনও সেটা ডিসঅ্যাডভান্টেজ আমেরিকা। কারণ, ৯/১১–র হামলার বার্ষিকী পালনের ঠিক আগে কাবুলে উড়ছে তালিবান পতাকা, মার্কিন জনমতই–বা কীভাবে এটা মেনে নেবে?
(সুচিক্কণ দাস সাড়ে ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তিনি ‘আজকাল’ পত্রিকায় কর্মরত। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে আজকালের উত্তর সম্পাদকীয় পাতায়।)