রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী কলকাতা থেকে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পর বিভিন্ন মহলে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। তবে বিতর্কের মুখে তিনি কিছুটা সুর বদলে জানিয়েছেন, কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম পরিষেবা এখনই বন্ধ হচ্ছে না। ট্রামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কলকাতাবাসীর ভাবাবেগ। সেই ভাবাবেগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পরিবহন মন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনই পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ট্রাম তুলে দেওয়ার কোনও দিন-তারিখও ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে হাইকোর্টে মামলার প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন পরিবহন মন্ত্রী। তাঁর কথায়, “চাইলেই এখন দুম করে বন্ধ করা যাবে না, কারণ কলকাতা হাইকোর্টে মামলা চলছে।
মামলা শেষ হওয়ার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”গত বছর ডিসেম্বরে ট্রাম নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলাকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সরকার ট্রাম চালাতে না পারলে, কলকাতার দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই পরিবহন ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। হাইকোর্ট বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি তৈরি করেছে। রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সঙ্গে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে কমিটির।
তবে ট্রাম তুলে দেওয়ার বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। পরিবহন দফতরের বক্তব্য, কলকাতার যান চলাচলে গতি আনার স্বার্থেই ট্রাম তুলে দেওয়া জরুরি। যানজট এবং দুর্ঘটনার কারণে ট্রাম চালানো নিয়ে আপত্তি তুলেছে কলকাতা পুলিশ। ট্রাম ধীর গতির যান। চলন্ত ট্রামেও অনেক যাত্রীকে ওঠানামা করতে দেখা যায়। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ট্রামের লাইনে বাইকের চাকা পিছলে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে। বর্ষার সময় এই ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। তাই ট্রাম লাইন তুলে ফেলার পক্ষেই পুলিশ। তাতে সায় রয়েছে প্রশাসনের একাংশের। গত কয়েক বছরে জনসংখ্যা ও তার সাথে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু রাস্তা চওড়া হয়নি। কলকাতায় যান চলাচলের যোগ্য রাস্তা রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ, যা দিল্লিতে ১৮ এবং মুম্বইয়ে ১০ শতাংশ।
ট্রাম তুলে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার তৎপর হয়ে উঠলেও, পরিবেশবিদরা ঘোরতর আপত্তি তুলেছেন। যানজট এবং দুর্ঘটনার কথা বলা হলেও, তাঁরা সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পরিবেশ-বান্ধব এই যানের প্রতি তেমন নজর দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু তথ্যও তুলে ধরেছে ট্রাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ৬১ কিলোমিটার লাইনে ট্রাম চলত, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১২ কিলোমিটারে। ২০১১তে ৩৭টি রুটে ট্রাম চালানো হত। আর এখন মাত্র দুটি রুটে ট্রাম চলে। ওই সময় দৈনিক ৭০ হাজার মানুষ ট্রামে যাতায়াত করতেন, যা এখন নেমে এসেছে পাঁচ হাজারে।
ট্রাম বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু ঐতিহ্য রক্ষা নয়, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নত পরিবহন পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ ট্রামকে ঝাঁ চকচকে আরামদায়ক পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলেছে।
গোটা বিশ্বে এখন প্রায় সাড়ে চারশোরও বেশি শহরের রাজপথে ট্রামের চাকা গড়িয়ে চলেছে। সেখানে কলকাতায় এশিয়ার প্রাচীনতম ট্রাম পরিষেবা কেন বন্ধ করে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, এই প্রশ্নও তোলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এক বন্ধু পর্যটক জানিয়েছেন, তিনি ইউরোপের ২৪টি দেশের প্রায় ৭০টি শহরে ঘুরেছেন। একমাত্র আইসল্যান্ড বাদে ইউরোপের সব দেশেই অন্যান্য যানবাহনের মতোই ট্রামের সমান গুরুত্ব রয়েছে। বড় ছোট প্রায় সব শহরেই ট্রাম আছে এবং মানুষ ট্রামের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। দেশগুলির প্রশাসন পরিবেশ সচেতন। তাই ট্রামের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে ট্রামে করেই আপনি ঘুরে দেখতে পারেন গোটা শহরটাই। এর জন্য আপনাকে কোনও ভাড়া দিতে হবে না, পুরোটাই বিনামূল্যে।
ছবির মতো সাজানো শহর হল চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ। গোটা শহর জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ট্রাম রুট। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ট্রামের দেখা মিলবে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট-এ। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ট্রাম চালু রয়েছে ১৮৮০ সাল থেকেই। এই শহরের মানুষ ট্রামের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।
বিশ্বের অন্যতম বড় ট্রাম নেটওয়ার্ক চালু রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়। এই শহরে ট্রাম চালু হয়েছিল ১৮৬৫ সালে। বর্তমানে ট্রাম এই শহরের গণ পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ২৫০ কিমি, রাশিয়ার মস্কোয় ১৮২ কিমি ও সেন্ট পিটার্সবার্গে ২০৫.৫ কিমি, জার্মানির বার্লিনে ১৯৩ কিমি, ইতালির মিলানে ১৮১.৮ কিমি এবং ফ্রান্সের প্যারিসে ১০৫ কিমি. পথে ট্রাম চলাচল করে।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন শহর ট্রাম তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক দশকে বিভিন্ন শহরে আবার স্বমহিমায় ফিরে আসছে ট্রাম পরিষেবা। কোথাও কোথাও একেবারে নতুন করে ট্রাম লাইনও পাতা হচ্ছে। ট্রামকে ফেরানোর কেন এই উদ্যোগ? কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বাসের চেয়ে ট্রাম অনেক বেশি উপযোগী। বাসের তুলনায় ট্রামের যাত্রী ধারণক্ষমতা অনেক বেশি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনগত খরচও অনেক কম।
কিছু কিছু জায়গায় ট্রামের জন্য সুনির্দিষ্ট লাইন থাকলেও, অনেক জায়গাতেই কলকাতার মতো শহরের কেন্দ্রস্থলে রাস্তায় উপর দিয়েই ট্রাম চলাচল করে। উন্নত ট্রাফিক পরিচালন ব্যবস্থা থাকায় কোথাও যানজটের সমস্যা হয় না, দুর্ঘটনাও ঘটে না।
বিশিষ্ট পরিবেশ প্রযুক্তিবিদ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষের মতে, কলকাতায় ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। ট্রামের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি লাইনেরও সংস্কার প্রয়োজন। তাঁর কথায়, একদিকে যেমন আরও বেশি সংখ্যায় ট্রাম চালানো প্রয়োজন, তেমনই ট্রামে চড়ার জন্য পর্যটকদের উৎসাহিত করতে হবে।
কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তবে যাত্রী না হওয়ায় ১৮৮০-তে পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় অবশ্য ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল। ট্রাম কোম্পানির হাতে ছিল ১৭৭টি ট্রাম। সেগুলি টানার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছিল ১০০০টি ওয়েলার ঘোড়া। কিছু সময় ধরে স্টিম ইঞ্জিনে ট্রাম চালানোর পর ১৯০২ সালে চালু হয় বৈদ্যুতিক ট্রাম।
ট্রাম গবেষকদের মতে, খিদিরপুর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত চালু হওয়া লাইনেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবার সূচনা হয়েছিল। মানুষ যাতে কম খরচে যাতায়াত করতে পারেন, সেই কথা ভেবেই ট্রাম পরিষেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন।
পরিবেশ বান্ধব যানবাহন ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়ে চারদিকে যখন আলোচনা চলছে, বিশ্বের দেশে দেশে যখন ট্রামের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হচ্ছে, তখন কেন কলকাতা থেকে ট্রামকে তুলে দিতে এত তৎপরতা?
আসলে ট্রামের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাম আমলেই। কোনওরকম আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অন্যান্য শহরে ট্রামকে নতুন-নতুন প্রযুক্তি দিয়ে ঢেলে সাজানো হলেও, এখানে কিছুই করা হয়নি। দিনের পর দিন ব্যবহারের ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই অকেজো হয়ে পড়েছে বহু ট্রাম।
ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, একটি ইলেকট্রিক বাসের দামে অন্তত ৯ থেকে ১০টা পরিবেশবান্ধব ট্রাম তৈরি করা সম্ভব। তাঁদের মতে, একটি ইলেকট্রিক বাসের ব্যাটারির দামেই অন্তত ৩-৪টে ট্রাম তৈরি করা যেতে পারে। একটা ইলেকট্রিক বাসের আয়ু যেখান ১০ বছর, সেখানে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণের খরচেই একটি ট্রামকে ৪০ থেকে ৫০ বছর চালানো যেতে পারে।
ট্রামকে ঘিরে ঐতিহ্য, আবেগ যাই থাক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের বাড়বাড়ন্তের যুগে এই যানের প্রয়োজনীয়তাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।