ড. বিকাশ পাল
(মেদিনীপুরের মানুষ ড. বিকাশ পাল লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক। প্রবাসী কিন্তু মন পড়ে আছে তাঁর এই রাজ্যে, নিজের মাতৃভূমিতে। সেই অনুভূতির প্রকাশ এই লেখায়। শুধুমাত্র এই পোর্টালে।)
“আকাশ কাঁদে হতাশ সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার
পরাণ সখা বন্ধু হে আমার
আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।”
রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলির এই কবিতার প্রেক্ষাপট পদ্মার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক বিধ্বংসী ঝড়ের রাত্রি। কবি সে রাতটা পদ্মার বোটেই ছিলেন । তিনি শিলাইদহর কুঠিবাড়ি থেকে নিয়মিত তাঁর জমিদারির অন্যান্য দপ্তরে জলপথেই যেতেন।
এভাবেই তিনি সাজাদপুরের কাছারিতে শিলাইদহ থেকে পদ্মার ওপর দিয়ে ইছামতী ধরে পাবনাকে বাঁয়ে রেখে প্রায় ৫০-৬০ মাইল নৌকো করেই প্রায় যেতেন। তাঁর পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর সাজাদপুরের জমিদারী মাত্র তেরো টাকা দশ আনায় কিনেছেলেন। এর আগে এটি ছিল নাটোরের রানি ভবানীর বংশধরদের হাতে ।
রাতের পদ্মার সাথে কবির নিবিড় অন্তরঙ্গতা। তাই রাতেই ইছামতী, পদ্মা ধরেই শিলাইদহ ফিরতেন। সে রাতে ঘোর অন্ধকারে মাঝি নদীতে নোঙ্গর করে ঝড়ের মোকাবিলা করছেন। কবি কিন্তু অবিচলিত, লেখায় মগ্ন। সব সময় জগত আর জীবন সম্পর্কে অনন্ত আশাবাদী। তাই তাঁর পরাণ সখা বন্ধুর অভিসারের আভাস পেয়েছেন। আমার ধারণায় এই পরাণ সখা আর কেউ নন। ইনি হলেন কবির অন্তরে অধিষ্ঠিত তাঁর সকল সৃষ্টি আর প্রেরণার প্রাণপুরুষ যিনি তাঁকে অহরহ অফুরন্ত শক্তি জুগিয়ে চলেছেন।
সেই জন্য একমাত্র তিনিই এই ধরনের দুর্যোগেও চলন বিলে ঝড়ে দুলতে থাকা নৌকোতে বসে লিখতে পারেন : “তুমি সন্ধ্যার মেঘ মালা আমার সকল সাধের সাধনা।”
খবরে পড়লাম আজ ‘ইয়াস’ নামের ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছে উপকূলবর্তী বাংলায়। আমাদের তাতে ভয় পেলে চলবে না। কেন্দ্র আর রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের সকল স্তরের আধিকারিকরা কয়দিন ধরে সমন্বয় করে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছেন। মানুষের মুখ্যমন্ত্রী দিনরাত এক করে নবান্ন থেকে পরিচালনা করছেন, সকলকে মনোবল যোগাচ্ছেন। আমার ধারনা এটা আমফানের মত ভয়াবহ হবে না। আমার বিশ্বাস, শীঘ্রই যখন ভাটার টান শুরু হবে, যেখানের জল সেখানেই চলে যাবে। ঘরের মানুষ ঘরে ফিরবে ।
এই ধরনের ঝড়ঝঞ্ঝা আমাদের জীবনকে আরও ভালোবাসার শক্তি জোগাবে। এতে আমাদের বাঁচার আগ্রহ আরও বাড়বে। অতিমারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি মানুষের অদম্য আশাবাদের কাছে হার মানবেই। রবিঠাকুর সে পথ তো আমাদের দেখিয়েছেন। আমাদের আবার দেখা হবে। সবাই ভালো থাকবেন।