সংযুক্তা সরকার
অসমের গুয়াহাটি শহরে বেড়াতে গেলে আপনি নিশ্চয়ই শহরের বুকেই কোথাও থাকতে পছন্দ করবেন। অথবা রেল স্টেশন বা বিমানবন্দর লাগোয়া কোনও হোটেলে। সেখান থেকেই সারবেন কামাখ্যা মায়ের দর্শন। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে দেশের একমাত্র নবগ্রহ মন্দিরটিও কিন্তু দেখার মতো। বিশেষ বিশেষ দিনে ভিড়ও হয় খুব। পরদিন হয়তো রওনা দেবেন কাজিরাঙার পথে। আর ব্রহ্মপুত্র? সে তো আছেই। তার বিশাল, ব্যাপক চেহারা তো আর লুকিয়ে রাখার নয়। যাতায়াতের পথে উঁকি ঝুঁকি মারতেই থাকবে নজর কাড়তে।
এই সাজানো ভ্রমণপথকেই যদি একটু এলোমেলো করে দিতে চান কিংবা যদি নদী নিয়ে আপনার মনের কোণে আমার মতোই দুর্বলতা থেকে থাকে, অথবা আপনার শহুরে মন যদি শহরবিমুখ হতে চায়, ভালো কিছু পাওয়ার জন্য সময় আর পকেটের সঙ্গে একটু সমঝোতা করতে রাজি থাকে, তাহলে বলবো আমার সঙ্গে চলুন সুয়ালকুচিতে। গৌহাটি শহর থেকে প্রায় ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সবুজ মোড়া সুয়ালকুচি গ্রাম। স্থানীয়রা বলেন, হুয়ালকুসি। মূলত মুগা, এরি সিল্ক ও সাদা পাটের জন্য এই গ্রাম বিখ্যাত। ওখানেই তৈরি হয় অথেন্টিক অসম সিল্ক আর তাই দিয়ে বোনা হয় অপূর্ব কারুকাজের মেখলা-চাদর। এই মিশেলের যুগে মূল শহরে যার গুণগত মান ও দাম দুয়েরই ফারাক রয়েছে বিস্তর। পাশ ঘেঁষে যাওয়া রাস্তার নাম ‘সিল্ক রুট’।
সরাইঘাট ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগোলেই সুদীর্ঘ, ছিমছাম রাস্তা এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। আগাগোড়া পিচবাঁধানো মসৃণ রুট বলে দেয় ‘সিল্ক’ নামটা নেহাতই কাকতালীয় নয়। দুপাশে ইতস্তত বাড়িঘর আর চোখে ধাঁধা লাগানো সর্ষের ক্ষেত। খানিক গিয়ে মোড় ঘুরতেই তাঁর দেখা মিলবে। একটু দূরত্ব রেখে পাশ ঘেঁষে নিজের খেয়ালে এগিয়ে চলেছেন ব্রক্ষ্মপুত্র। খুবই শান্ত, খুবই একা। এ যেন এক অন্য নদী। ব্যাকরণ মেনে বলতে হয়, ‘নদ’। শহরের বুক চিরে এগিয়ে যাওয়া সেই সদর্প ঘোষণা, সেই বিশালতা, সেই ব্যাপকতা আর নেই। এখানে তিনি স্পষ্টতই বৃদ্ধ হয়েছেন। আরও যেন গম্ভীর, আরও যেন উদাসীন। খানিকটা গেলেই জিপিএস জানিয়ে দেবে আপনি পৌঁছে গেছেন আপনার গন্তব্যে, “সিল্ক রুট রেসর্ট এন্ড স্পা”। এছাড়াও রয়েছে, “রিভার ডিংগাল”। থাকার মতো জায়গা বলতে ওই দু-একটিই। মোরাম বেছানো মেঠো রাস্তা আপনাকে পৌঁছে দেবে রিসর্টের দরজায় যেখানে হাসিমুখে পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে কয়েকজোড়া চোখ। আতিথেয়তার উষ্ণতা বুঝিয়ে দেয় আপনি একশো শতাংশ ঠিক জায়গাই বেছেছেন।
বাঁ দিকে তাকালেই চোখে পড়বে শান্ত, সমাহিত, ধূসর ব্রহ্মপুত্র। বুকে শুধু প্রজাপতির মতো ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে দু-চারটে মাছ ধরা নৌকো। আর ঠিক ওখানেই একটা বড়ো কালো পাথরে ধাক্কা খেয়ে নিজের পথ পাল্টে নিয়েছে ব্রহ্মপুত্র। নদীর পার বরাবর বেশ অনেকটা জুড়েই রেসর্ট। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো লন। ঝুমকো লতার কেয়ারী করা গেট। তারই পাশ দিয়ে নারকেল আর সুপারি গাছের সারি। রয়েছে ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ছোটোখাটো সুইমিং পুলও। আর আছে বন-ফায়ার ও ক্যাম্পিং করার সুবন্দোবস্ত। পরিচর্যা যে হয় তা টের পাওয়া যায় ভোরবেলায়। আলো ফুটতে না ফুটতে সক্কাল সক্কাল কাজে লেগে পরে মৃণাল, আসিফুলরা। আর সবসময় আপনার দরকার-অদরকারে জিনির মতো এসে হাজির হন রতন দত্ত। সম্ভবত অতিথিদের খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সুবিধে-অসুবিধের খেয়াল রাখার দায়িত্বে আছেন তিনি।
সকাল সকাল প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ুন তাঁতিদের গ্রাম দেখতে। শপিংয়ের ইচ্ছে থাকলে রথ দেখা আর কলা বেঁচা দুই-ই সেরে ফুল, পাখি, গাছ আর পরিপাটি পথঘাট দেখতে দেখতে রিসর্টে ফিরুন। জমিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে, রোদ গায়ে জড়িয়ে নদীর পার ধরে খানিক হেঁটে আসলেও মন্দ লাগবে না। সাবধান, নদীর পারের মাটি কিন্তু নরম!
পরদিন চাইলে কামাখ্যা দর্শনও সারতে পারেন ভোর ভোর বেরিয়ে। তারপরে বেরিয়ে পড়তে পারেন কাজিরাঙার পথে। গাড়ির ব্যবস্থা নিয়ে ভাববেন না। রতনবাবু আছেন তো!