হোমভ্রমণঅপরূপ মুন্নার আর সেই আশ্চর্য হোটেল

অপরূপ মুন্নার আর সেই আশ্চর্য হোটেল

অপরূপ মুন্নার আর সেই আশ্চর্য হোটেল

শ্যামল সান্যাল : হোটেলে ঢোকার মুখেই একটা বিশাল সেই আদ্দিকালের প্রজেক্টর। ঝক ঝক করছে। একটা ফিল্মের দেখা মিলবে। যেন ওটা থেকে এক্ষুনি হলের পর্দায় সিনেমার ছবি পড়বে। হলের দর্শকদের হাসি-কান্না শুরু হবে। হাততালি পড়বে। এইসব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে মনে হতে পারে, এটা হোটেল তো নাকি সিনেমা হল?

জায়গাটার নাম মুন্নার। অসাধারণ সুন্দর। কেরালা কেন, দক্ষিণ ভারতের কোথাও এমন সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলবে না। দিনের বেলায়ও গরম নেই। রাতে ঠান্ডা। লক্ষ লক্ষ পর্যটক, দেশি বিদেশি মানুষের ভিড় লেগে থাকে।

সে কথা থাক। হোটেলের ভেতরে ঢোকা যাক। বিশাল লবি, রিসেপশন। কিন্তু এত খালি সিনেমার ছবি।পৃথ্বীরাজ কাপুর, মধুবালা, সুরাইয়াদের বিশাল বিশাল ছবি। বড় বড় ফ্রেম। যেন একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে পেন্টিং এক্সিবিশন।

এই প্রতিবেদক ভাবে, ভুল করে সিনেমা হলে চলে এসেছে। ধন্ধ কাটাতে রিসেপসনের সুন্দরীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা ম্যাডাম, এটা কি সিনেমা হল? হোটেল মনে করে চলে এসেছি..।

এক গাল হেসে পরিষ্কার ইংরেজিতে তিনি বলেন, না না এটা হোটেল। আপনি ঠিকই এসেছেন। এই নিন আপনার ঘরের চাবি। ইউ আর ওয়েলকাম।
যাক, তাহলে হোটেলেই আসা গেছে। লিফটে উঠে দু তলায় ঘরে ঢোকার সময়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা। তিনি এখানে সুন্দর ফ্রেমে জ্বলজ্বল করছেন।তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য দেওয়া আছে অতি যত্ন করে। নন্দনেও এত সুন্দর করে তাঁর কথা এক ঝলকে মেলে কি?

ঘরে ঢোকার মুখে শাহরুখ, তাঁর বিশাল ছবি । ঘরের ভেতরে নানা সিনেমার ইতিহাস, নায়ক, নায়িকার সুন্দর সুন্দর ছবি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাবার সময়ে এক টুকরো মেঘ এসে বলে, আরে কেমন আছ,তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে এলাম।তোমার ঘরে আসতে আমার কি পারমিশন নিতে হয় নাকি, তুমি তো আড্ডাবাজ। কাজের নাম করতে চাও না..।


মেঘবালিকা মিষ্টি হাসে। আমি বলি, এসো এসো আমার ঘরে এসো..
দরজার বেল জলতরঙ্গের সুরে বাজে। এক পট চা ,কাপ প্লেট ..নিয়ে তরুণ যুবক বলে দুধ আলাদা আছে , চিনি আছে আপনার যেমন ইচ্ছে করে নিতে পারেন। আমিও করে দিতে পারি স্যার। আর ওখানে চা কফি সব আছে। ইলেকট্রিক কেটলি ওটা। আপনি যত খুশি বানিয়ে নিতে পারেন। আর ওইটা হল ছোট ফ্রিজ। ওখানে বিয়ার,হুইস্কি ভদকা আছে। গ্লাসও রাখা আছে। আপনি নিতে পারেন। তবে আমাদের বারেও আসতে পারেন স্যার। আমরা সার্ভ করব। ইম্পর্টেড ড্রিংকস শুধুমাত্র দিয়ে থাকি, ইফ ইউ প্লিজ…।

কটা দিন এই হোটেলে ছিলাম। ৪ তারা এই হোটেলের সব কটা তলা ঘুরে শুধুমাত্র বিস্মিত হয়েছি। সারা দুনিয়ার নানান হোটেলে বাস করেছি। হলিউড, লন্ডন, প্যারিস কোথাও এমন সিনেমা দিয়ে ডেকোরেশন চোখে পড়ে নি। সিনেমার অভিজ্ঞ পন্ডিতদেরও এমন খবর জানা নেই।

সিলভার টিপস নামে এই হোটেলটি 1920 সালে ছিল এক সিনেমা হল। নাম ছিল পঙ্কজম থিয়েটার। এ এস অঝগনান ছেত্রী নামে এক বড় ব্যবসায়ী এর মালিক ছিলেন। তাঁর গিন্নি ছিলেন মেমসাহেব। সেদিন টিকিটের দাম ছিল ব্যালকনিতে 4 আনা, সাধারণ সিট 1 আনা। চার আনা মানে 16 পয়সা!

তামিল ও ইংরেজি সিনেমা দেখতে খুব ভিড় হত। আমেরিকা থেকে প্রজেক্টর আনা হয়েছিল। সেই প্রজেক্টরটিই ঢোকার গেটে আজও দাঁড়িয়ে।
টিভি আসার পরে লোকেরা আর এই হলে আসতেন না। ফলে লোকসান হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত, ওই হল ভেঙে তৈরি হল এই হোটেল।

আজ এই হোটেলের মালিক জেমস ম্যাথু। ষাট-বাষট্টির মত বয়স। কেরালাতে তাঁর কুড়িটা সিনেমা হল ও দুটো হোটেল আছে। উনি বল্লেন, সিনেমা তাঁর প্রিয় বিষয়। তাই এরকমভাবে সাজিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁর বিশেষ বন্ধুদের দল আছে। দিলীপ কুমার কে দেখিয়ে বলেন, সব ক্রেডিট ওঁর। ওঁরা কোলকাতায় আসবেন, সিনেমার আরও ছবি ও ইতিহাস জোগাড় করতে।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img