সুপ্রিয় মুখার্জি
ইউরোপ মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ আইসল্যান্ড, স্বপ্নের মত সুন্দর একটি দেশ। প্রত্যেক বছরই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা সেখানে ভ্রমণ করতে যান। তাঁদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হল, সেখানকার ডলফিন। আইসল্যান্ডের সমুদ্রতীরের নানা ধরনের ডলফিন ইউরোপ ও আমেরিকান পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।
আইসল্যান্ড অনেক দূরের দেশ। জানেন কি, পাশের রাজ্য বিহারের ভাগলপুরে রয়েছে একটি ডলফিন অভয়ারণ্য। ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জ থেকে কাহালগাঁও পর্যন্ত গঙ্গার 50 কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এর বিস্তৃতি। ১৯৯১ সালে এর নামকরণ করা হয় “বিক্রমশিলা ডলফিন অভয়ারণ্য”।
জলজ প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়ায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডলফিনের একমাত্র সুরক্ষিত জায়গা হল এই অঞ্চল। গঙ্গা ডলফিনের আরেক নাম হল, শুশুক।
একসময় এই জাতীয় ডলফিন দেশে বহু সংখ্যায় দেখা যেত। এখন তা কয়েকশোতে নেমে এসেছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই দেখা যায় এই অঞ্চলে।
নদীর জল দিন দিন দূষিত ও নোংরা হতে থাকায় এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়া, ২০০৬ সালে গঙ্গা ডলফিনকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে IUCN (International Union for Conservation of Nature)।
এর কয়েক বছর পর, ৫ অক্টোবর, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহের সভাপতিত্বে জাতীয় গঙ্গা নদী অববাহিকা কর্তৃপক্ষের (NGRBA: National Ganga River Basin Authority) প্রথম বৈঠকে গঙ্গা ডলফিনকে ভারতের জাতীয় জলজ প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে নেমে যখন গঙ্গা সমতলে প্রবেশ করে, তখন তার জল মারাত্মকভাবে দূষিত হতে থাকে। তবে নেপাল থেকে নেমে আসা ঘর্ঘরা, গণ্ডক এবং কোশি, এই তিনটি নদীর প্রবাহ গঙ্গার জলকে দূষণমুক্ত করে।
ভাগলপুরে গঙ্গার জল তুলনামূলকভাবে অনেক স্বচ্ছ, যা এই অঞ্চলকে ডলফিনদের জন্য উপযোগী করে তুলেছে। এই এলাকায় বর্তমানে ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ২০০র কাছাকাছি।
এই বিক্রমশিলা অভয়ারণ্যে অন্যান্য দুর্লভ জলজ বন্যজীবও রয়েছে, যার মধ্যে ভোঁদর বা উদবিড়াল (Lutrogale Perspicillata), গঙ্গা কুমির বা ‘ঘড়িয়াল’ (Gavialis gangeticus), বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ এবং ১৩৫ প্রজাতির ‘জলকুক্কুট’ পাখি রয়েছে। এছাড়াও এই অঞ্চলটির বিশ্বের সবচেয়ে বড় “বিলুপ্তপ্রায় গরুড় পাখিদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন অঞ্চল” হিসেবে পরিচিত। পুরাণ মতে, গরুড় হল ভগবান বিষ্ণুর বাহন।
অভয়ারণ্য এলাকায় বিভিন্ন সংরক্ষণের কাজ চলছে। ডক্টর সুনীল চৌধুরীর নেতৃত্বে বিক্রমশিলা বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টার (VBREC), পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান গবেষণাগারের তিমি ও ডলফিন সংরক্ষণ সমিতি (WDCS), এবং ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়, একসাথে মিলে বিক্রমশিলা গঙ্গা ডলফিন অভয়ারণ্যের সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য একটি বৃহৎ প্রকল্প শুরু করেছে।। তাছাড়া কয়েক বছর আগে WWF-Indiaও গঙ্গা নদীর ডলফিনদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার জন্য ‘ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম’ শুরু করেছিল।
অনন্য সুন্দর এই বিক্রমশিলা অভয়ারণ্য এবং গাঙ্গেয় ডলফিনের মোহনীয় সৌন্দর্য দেখতে চাইলে একবার ঘুরেই আসতে পারেন সিল্ক সিটি ভাগলপুর। এই ডলফিন দেখার সেরা সময় হল, অক্টোবর এবং জুন মাস। জুন মাসে সেখানকার তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাই অক্টোবর-নভেম্বর ভ্রমণের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী।
নিকটতম রেলস্টেশন ভাগলপুর জংশন। হাওড়া ও শিয়ালদাহ থেকে ভাগলপুর যাওয়ার কয়েকটি ট্রেন আছে। যেমন হাওড়া-জামালপুর এক্সপ্রেস, হাওড়া-গয়া এক্সপ্রেস। কমবেশি ১০ ঘন্টার যাত্রা। ভাগলপুরে কোনও বিমানবন্দর নেই। নিকটতম বিমানবন্দরটি পাটনায়। সেখান থেকে ভাগলপুর সড়কপথে ৬ ঘণ্টার রাস্তা। ভাগলপুরের পশ্চিমে সুলতানগঞ্জের থেকে নিয়ে ভাগলপুরের পূর্বে কাহালগাঁও পর্যন্ত অঞ্চলটির যে কোনো পরিচিত ঘাটে গিয়ে নৌকাবিলাস করতে পারেন, পুরোটাই অভয়ারন্যের মধ্যে পড়ে।
উল্লেখযোগ্য ব্যারারি ঘাট, যেখানে বিক্রমশিলা সেতু শুরু হয়। এছাড়াও ভাগলপুরে ঘুরে দেখতে পারেন প্রাচীন বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ, জৈন মন্দির, আজগুবিনাথ ধাম, বটেশ্বরনাথ মন্দির ও শান্তি বাবা ধাম, বুড়োনাথ মন্দির, রবীন্দ্র ভবন অর্থাৎ টিলহা কুঠি ও মন্দার পর্বত।