হোমভ্রমণনবদ্বীপের মায়াপুর যেখানে শেষ,তারপর....

নবদ্বীপের মায়াপুর যেখানে শেষ,তারপর….

নবদ্বীপের মায়াপুর যেখানে শেষ,তারপর….

দেবস্মিতা নাগ: নবদ্বীপের পরের স্টেশন বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট। আগে এটিii হল্টই ছিল,থামতো না সব লোকাল ট্রেন,এক্সপ্রেস তো দুরস্থ।এখন পর্যটক ও পুণ্যার্থীর চাপে সেখানে বেশিক্ষণ গাড়ি থামে। কারণ,দূরদূরান্ত থেকে আগত যাত্রীরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে,নবদ্বীপ ধাম নয়,মায়াপুরের দূরত্ব বিষ্ণুপ্রিয়ার থেকে বরং কম।

বিষ্ণুপ্রিয়ার যে দিকে নবদ্বীপ শহর ,তার বিপরীতে একের পর এক গ্রামে ছড়িয়ে আছে শ্রী চৈতন্যের বহু স্মৃতি। প্রথম গ্রাম শ্রীরামপুর। গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলে পড়তে যাওয়া ও আসার পথে এখানে নিমাই বিশ্রাম নিতেন বলে গ্রামের নাম হয়েছিল বিশ্রামপুর।পরে বিশ্রামপুর লোকমুখে হয়ে যায় শ্রীরামপুর।

এর পর একটা গ্রাম পেরিয়ে আসে বিদ্যানগর, বিদ্যানগর নামের জন্মের পিছনেও রয়েছে নিমাই পন্ডিতের বিদ্যাচর্চার ইতিহাস। বিদ্যানগর গ্রামের কাছাকাছি গ্রাম গঙ্গানন্দপুর,সেখানে রয়েছে গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোল,আর তার চত্বরে বিশাল এক কলম গাছ।

কথিত আছে নিমাই এখানে একটি কলম ফেলেছিলেন। সেই থেকেই এই বিশাল বিরল বৃক্ষের জন্ম। প্রকৃত সত্য হলো এই যে, এটি একটি ‘কলম'(হাইব্রিড)জাতীয় গাছ,যা চৈতন্যদেব সৃষ্টি করেছিলেন,আর সেই কারণেই এই গাছ বিরল,আশেপাশে এর কোনো পারিবারিক সদস্যের দেখা মেলে না।

বিদ্যানগর ও গঙ্গানন্দপুর গ্রামের মাঝামাঝি রয়েছে কোবলা গ্রাম। আগে চৈতন্যের সময় বাসুদেব সার্বভৌম এই গ্রামে থাকতেন। সেই কারণেই এই অঞ্চলে অবস্থিত গঙ্গার পরিত্যক্ত খাতকে বাঁশদা র বিল বলে। বাসুদেব নামটি কালের স্রোতে প্রথমে বাঁশদহ ও পরে বাঁশ দা হয়।

গঙ্গার পূর্বখাত তখন এই গ্রামের পাশ দিয়েই প্রবাহিত হতো। পরবর্তীতে গঙ্গার এই খাত বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরাট এক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করে, যার নাম হয় চাঁদের বিল। এই নামের পিছনেও রয়েছে পৌরাণিক বিশ্বাস। মনসামঙ্গলে বর্ণিত চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা এই খাতেই ডুবেছিল বলে স্থানীয় বিশ্বাস। এর ভৌগোলিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। চৈতন্যের দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার নামানুসারে স্টেশনের নাম বিষ্ণুপ্রিয়া।

বিষ্ণুপ্রিয়ার পরের স্টেশন ভান্ডারটিকুরী। ভান্ডারটিকুরীর কাছাকাছি মাধাইপুর শ্মশান। একসময় সেখানেই ছিল জগাই মাধাই জুটির মাধাইয়ের বাড়ি। ভান্ডারটিকুরীর কাছাকাছি আরেকটি গ্রাম জাহান্নগর,পুরাণে কথিত যে, জাহ্নমুনির জানু থেকে জাহ্নবী(গঙ্গা) প্রবাহিত হয়েছিলেন,সেই জাহ্নমুনির আশ্রমও এই গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে পৌরাণিক বিশ্বাস।

এই স্টেশনের সংলগ্ন একটি মনসা মন্দির আছে। অনেকের মতে, এই মন্দিরেই চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিয়েছিলেন। আজও শ্রাবণ সংক্রান্তিতে এই মন্দিরে অষ্টোত্তর শত ছাগবলি সহযোগে ব্রহ্মাণীমাতার পূজা হয়। এই মন্দিরের নামে গ্রামের নাম বর্তমানে ব্রহ্মাণী তলা। এক সময় এই মন্দিরে পূজিতা হয়েছেন বৌদ্ধ দেবী জাঙ্গুলী তারা বা নীল সরস্বতী,পরবর্তী কালে সেন বংশের অভ্যুত্থানের সময় হিন্দু ধর্মের প্রাদুর্ভাবের ফলে সমস্ত বৌদ্ধমন্দিরে হিন্দু দেবদেবীর আরাধনা শুরু হয়।

একই ইতিহাস নবদ্বীপ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পোড়ামাতলারও। ঐ মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন পোড়ো মা বা পড়ুয়া মা,নীল সরস্বতী। সেনদের আমলে সেই মা-ই হয়ে যান শক্তির দেবী। কোবলা গ্রামে বাকদেবী তলায় একটি মন্দির আছে। সেখানেও বীণাপাণি বাকদেবীর পূজা হতো বৌদ্ধ যুগে। এখন তা একটি হিন্দু শাক্ত মন্দির।

কোবলার চাঁদের বিল এখন সংরক্ষিত জলাশয়। ২৫শে ডিসেম্বর সেখানে সহস্র দীপ প্রজ্জ্বলিত করে খাল বিল উৎসব পালিত হয়। সরকারি বন ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উদ্যোগে। উৎসবে আসেন বিভিন্ন জেলার লোকশিল্পীরা। বিক্রি হয় হস্ত শিল্পের উৎকৃষ্ট পসরা,খাওয়া হয় বিলের সুস্বাদু মাছ। এছাড়াও চলে স্থানীয় সাধারণ মানুষদের নিয়ে পূজা ও প্রসাদ বিতরণ।

আগে এই সব জায়গা পর্যটকদের দৃষ্টিপথের বাইরে ছিল। তীর্থ যাত্রীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় মানুষ,নেতা মন্ত্রী ও সরকারি প্রচেষ্টায় স্থানগুলি আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে।বেড়েছে পর্যটকের আনাগোনা। বসন্তকালে দোল উৎসবের সময় বিদেশি পর্যটকের ভিড় জমে এইসব এলাকায়। তবে সেই বর্ণময় শোভাযাত্রার পরিসর এই বছর অতিমারীর কারণে ছিল অনেকটাই ছোট।পৃথিবী সুস্থ হলে ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের তালিকায় এই অঞ্চলকে রাখলে তৃপ্তি পাবেন অনেক পর্যটক।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img