হোমরাজ্যআবার ফিরতে চাই, লন্ডন প্রবাসী এক বঙ্গসন্তানের আত্মকথন

আবার ফিরতে চাই, লন্ডন প্রবাসী এক বঙ্গসন্তানের আত্মকথন

আবার ফিরতে চাই, লন্ডন প্রবাসী এক বঙ্গসন্তানের আত্মকথন

(লন্ডনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. বিকাশ পাল। ৩০ বছর পরবাসী। পিছন ফিরে দেখলেন নিজের অতীত। জীবনানন্দের কবিতার মতই যেন বললেন, “আবার আসিব ফিরে….”। অসাধারণ এই লেখাটি পাঠিয়েছেন শুধুমাত্র আমাদের পোর্টালের জন্যই।)

১৯৭৮ সাল। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। কয়েকদিনের বিরামহীন বৃষ্টি আর বিহারের বাঁধ থেকে ছাড়া জলে কাঁসাই নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়ে গেল। আমাদের ঘরবাড়ি, স্কুল সব জলবন্দি। বেশ কিছু গ্রামের গরিব মানুষের অস্থায়ী আস্তানা হয়ে উঠল আমাদের স্কুল। এই স্কুল আমার ঠাকুমাদের দেওয়া জমিতে হয়েছিল। তাই মনে হত বন্যা দুর্গত মানুষেরা যেন আমাদের জায়গাতেই আছে।

একসময় জল নেমে গেল। একে একে শরৎ, হেমন্ত, শীত এল। ফি বছর যেমন আসে আর যায়। মাঠের ফসল তো বানের জলেই নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে অন্নের অভাব, অর্থের অভাব। আমাদের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারের সাপ্তাহিক সাহায্য শুরু হয়েছে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে।

একদিন দেখলাম, আমার দাদা, বাবাকে সাইকেলে বসিয়ে ডেবরার State Bank of India থেকে কৃষি ঋণের জন্য গেল। কয়েকদিনের ছোটাছুটির পর আনল ১২০০ টাকা। আমাদের আড়াই বিঘা জমির দলিল চলে গেল ব্যাঙ্কের হেফাজতে। সেই টাকায় আমাদের সে বছর শীতকাল পর্যন্ত চলেছিল। শীতও গেল। জমিতে আলু, লঙ্কা, টম্যাটো, সর্ষে হল। স্কুলের শেষে শনি ও মঙ্গলবার সে সব হাটে বিক্রি করতে যেতাম মাঝে মাঝে। আস্তে আস্তে গ্রামের মানুষের জীবনে একটা ছন্দ ফিরে এল। নতুন বাংলা বছরও এল বসন্তের শেষে।

বন্যার জলে ভেঙে যাওয়া কাঁসাই নদীর বাঁধ মেরামতির সরকারি উদ্যোগ শুরু হল। কেননা আবার তো বর্ষাকাল এলো বলে। রোজ আমাদের আর আশেপাশের গ্রামের বহু মানুষ মাটিভর্তি ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাঁধ বাঁধার কাজ করেই চলেছে দিনের পর দিন। দিনের কাজের শেষে তারা ঠিকাদারদের থেকে টাকা পেয়ে মুকসুদপুর বাজারে চাল কিনতে আসত। দাদা বালিচকের বাজার থেকে সাইকেলে চাল কিনে এনে এদের বিক্রি করত কিছু লাভের আশায়। আমি হিসেব করে পয়সা নিতাম, সে বেতের দাঁড়ি পাল্লায় চাল ওজন করে সবাইকে দিত।

বালিচক দক্ষিণ-পূর্ব রেলের একটি স্টেশন। হাওড়া থেকে খড়্গপুর পৌঁছনের ২০ কিমি. আগে। আমাদের বাড়ি থেকে ১২-১৪ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে। দাদা ২ বস্তা চাল সাইকেলের সামনে আর পেছনে শক্ত করে বেঁধে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ি আসত। এই ১২-১৪ কিমি রাস্তার কয়েকটা জায়গায় চড়াই উতরাই ছিল। দুটো জায়গা মনে আছে, বালিচকের লকগেট আর খানামোহনের নদীর বাঁধ। ঐ জায়গায় সে একা একা চাল ভর্তি সাইকেল টেনে তুলতে পারতো না। সেখানে কাউকে পেছন থেকে সাইকেল ঠেলতে হত। সেজন্য সে আমায় সাইকেলে বসিয়ে বালিচক নিয়ে যেত। রবিবার স্কুল থাকত না। অতটা রাস্তা সাইকেলে বসে যাব। বেশ আনন্দ হত। তাই চলে যেতাম দাদার সাথে।

আমি সাইকেল চালাতে পারতাম না ক্লাস ফাইভ সিক্স পর্যন্ত। বালিচকে চাল কেনার পর সাইকেল ভর্তি করে আমরা দু-ভাই ১২-১৪ কিমি সাইকেল নিয়ে হাঁটা লাগাতাম। দু-তিন ঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যেতাম। আমি মাঝে মাঝে সাইকেল পেছন থেকে ঠেলতাম। বিশেষ করে ঐ লকগেট আর খানামোহনের বাঁধের উঁচুতে ।

আমরা মাঝে ডেবরাতে চাল ভর্তি সাইকেল ঠেকিয়ে, চপ মুড়ি খেতাম। রাস্তার কলে হাত দিয়ে জল খেতাম। দাদা কল টিপত আর আমি খেতাম। পরে আমি কল টিপতাম দাদা জল খেত। আবার সাইকেল বোঝাই চাল নিয়ে হাঁটা লাগাতাম।

এই ডেবরাতেই স্টেট ব্যাংকের দোতলা বিল্ডিং। এর পাশ দিয়েই বালিচকের রাস্তা। তখন মনে হত, এর ভেতরের আলমারিতেই আমাদের আড়াই বিঘার দলিল জমা আছে। সুদ সহ টাকা না দিলে ঘরের দলিল ঘরে কোনোদিনই ফিরবে না।

বেশ কয়েক বছর পরে আমাদের পুকুর পাড়ের কিছু গাছ বিক্রি করে বাবা আর দাদা বেশ কিছু টাকা শোধ করেছিল। কিন্তু সুদে আসলে সে টাকা অনেক হয়ে গিয়েছিল। পুরোটা শোধ করতে পারেনি। তাই জমির দলিল ব্যাঙ্কেই ছিল।

১৯৮৮-৮৯ সাল নাগাদ যাদবপুরে আমি থার্ড ইয়ারে । কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম। পিকনিক গার্ডেনস আর নারকেলডাঙ্গায় দুটো টিউশন পড়িয়ে। মাঝে মাঝে কিছু স্কলারশিপও পেতাম ।

একদিন গরমের ছুটিতে বাডিতে আছি। বাবার কাছে শুনলাম, ব্যাঙ্কের অফিসার লোন শোধ করার জন্য মুকসুদপুরে ক্যাম্প করছে। অনেক লোকের বাকি, আমাদেরও বাকি। তাই তাগাদা দিতে এসেছে। অনেক সময় গ্রামের মানুষের হাতে টাকা থাকলেও তারা শোধ দিতে চায় না, ভাবে, সরকার হয়ত ছাড় করে দেবে। তাছাড়া তারা অত দূরে ব্যাঙ্কে যেতেও চায় না।

তবে ডাক মারফত ব্যাঙ্কের তাগাদার চিঠি পেলে ভয় পায়। অন্যদের জিজ্ঞেস করে, কী করবে। কেউ কেউ দিয়ে দেয়, আবার কেউ ব্যাঙ্ক মুখো হয় না। তাই ব্যাঙ্ক তখন এ ধরনের loan recovery camp বসায়। তখন লোকলজ্জার ভয়ে প্রায় সকলে টাকা দিয়ে দেয়। ব্যাঙ্কের ভেতর ব্যাঙ্কের অফিসার টাকা শোধ করার কথা বললে, যতটা লজ্জা, তার চেয়ে গ্রামের চেনা মানুষের কাছে টাকা চাইলে গ্রামের মানুষ বেশি লজ্জা পায়।

ব্যাঙ্ক গ্রামের মানুষের এই মনস্তত্বটিকে কাজে লাগায় টাকা আদায়ের জন্য। সেজন্য কাম্প বসায়। আমি শুনলাম, সেদিন চৌকিদার দিয়ে গ্রামে ঘোষণা করেছে কাম্পের কথা। দাদার কাছে জানতে পারলাম, আমাদের এখনও ৪৫০ টাকার মত দেনা আছে ব্যাঙ্কের খাতায়। আমার টিউশন আর স্কলারশিপের কিছু টাকা আমার কাছে ছিল। সঙ্গে টাকা নিয়ে আমি স্কুলে বসানো কাম্পে গিয়ে আমার বাবার নামের যে দেনা আছে সেটা শোধ করব বললাম ম্যানেজারকে। শোধ হয়ে গেল ব্যাঙ্কের ঋণ।ম্যানেজার বসতে বললেন। জানতে চাইলেন, কী করি। উৎসাহ দিলেন। মনে হল ভালো লোক।

বাড়িতে এসে দাদা আর বাবাকে বললাম, ম্যানেজার রসিদ দিয়েছেন, সব টাকা শোধ। বলেছেন বাবাকে ব্যাঙ্কে গিয়ে দলিল নিয়ে আসতে। দাদা একদিন আবার বাবাকে সাইকেলে বসিয়ে ডেবরা থেকে দলিল নিয়ে এল। লোন অ্যাকাউন্ট ক্লোজড। আড়াই বিঘা আমাদের ছিল, আমাদেরই থাকল। এ যেন ভগবান রামকৃষ্ণের লক্ষ্মীর জলা।

তারপর আমি যাদবপুরের পাঠ চুকিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেছি মাস্টার্স করতে। পরে দাদার কাছে শুনেছি, সেই ম্যানেজার ভদ্রলোক মাঝে মধ্যে দাদার সাথে বা আমাদের গ্রামের লোক কোনও কাজে ব্যাঙ্কে গেলে, তাদের কাছে আমার কথা জানতে চাইতেন। তিনি এখন কোথায় আমার জানা নেই।

আমার বাবার আড়াই বিঘার দলিল পরে আমার দুই দাদার দুই ছেলেকে আমার বাবা দিয়ে গেছেন। সমান পরিমাণ অন্য জমি আমাকেও দিয়ে গেছেন। আমার সেই দাদাও দিন কয়েক আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৭০ বছর বয়সে। আমার বাবা, দাদা আর নেই। কিন্তু সেই আড়াই বিঘা আছে, থাকবে। এক দিন আমারাও থাকব না কিন্তু ঐ আড়াই বিঘা থাকবে। তাই মানুষের জমি হয় না, জমিরই মানুষ হয়, land does not belong to us, we belong to the land, এই অনুভুতির কথা আমার অন্য লেখাতেও আগে লিখেছি।

দাদা আমায় কতটা ভালোবাসতো সেটা এখন বুঝতে পারছি। বাবার মত তাঁর আত্মারও শান্তি কামনা করি। তাদের জন্য কতটা করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু অনেক কিছুই করা হয়নি, অনেক কিছু বাকি থেকে গেছে। জন্মান্তর বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, আবার যেন আমার বাবা আর দাদাদের সাথে দেখা হয়। আবার যেন আমি আমাদের এই কাঁসাই নদী আর কিশমৎ রাজপুরার মত পরিবেশে এইরকমই বাবা দাদাদের মধ্যেই ফিরে আসতে পারি। আর তা শুধু একবার নয়, বার বার।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img