শ্যামল সান্যাল : জহরলাল নেহরু আর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মন কষাকষি প্রথম দিকে দিল্লির গাছপালা জানলেও তারা শব্দ করে হেঁকে কথা বলে না । ওখানে মোগল আমল থেকেই গভীর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, প্রেম, খুন চলে এসেছে । ইংরেজরাও সেই লাইনে দাবার চালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান করে দিয়েছে। নেহরু, গান্ধী, প্যাটেলদের মত অজস্র মানুষকে নিয়ে দিল্লিতে লোফালুফি করেছেন ইংরেজরা। লর্ড মাউন্টনবাটনের সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে জহরলালের সম্পর্কের ব্যাপারটা কেন গড়ে উঠেছিল সেটা অন্য প্রসঙ্গ। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কোটের পকেটে থাকত টাটকা লাল গোলাপ। সুদর্শন খানদানি, উচ্চ শিক্ষিত এক পুরুষ। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কেমন সম্পর্ক ছিল, সে কথাও না হয় থাক।
কিন্তু ওঁর প্রিয় কন্যা ইন্দিরা পিতার রকমসকম জানতেন। ইন্দিরা বহুবার পিতার কত গার্লফ্রেন্ডদের বুদ্ধি করে সরিয়ে দিয়েছেন, কাকে বাড়িতেই ঢুকতে দেননি, কাউকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠাতে গোপনে কলকাঠি নেড়েছেন, এই রাজ্যের রাজ্যপাল করে পাঠানোর বিষয়েও সুতো টেনেছেন। গা ছমছমে কত ঘটনা বানিয়ে লেখা উপন্যাসকে টপকে যেতে পারে। সে কথাও আপাতত থাক তোলা।
কিন্তু এই বঙ্গে একসময় রাজ্যপাল হয়ে এসেছিলেন পদ্মজা নাইডু, সেই কাহিনীর দিকে দেখা যাক বরং। কলকাতার রাজভবনে সেই রাজ্যপালের গল্প জানে ওই গোলাপ গাছেরা।
কে ছিলেন এই ভদ্রমহিলা ?
তিনি ছিলেন সরোজিনী নাইডুর মেয়ে। তাঁরা ছিলেন দুই বোন। পদ্মজা বড়। জন্ম ১৭ নভেম্বর, ১৯০০ সালে। তাঁর সম্পর্কে জহরলালের সচিব এম ও মাথাইয়ের স্মৃতিচারণ তুলে ধরা যাক : “তাঁর চোখে ছিল শয়ন কক্ষের ভঙ্গিমা, নিগ্রো মহিলার আকৃতির সঙ্গেও তাঁর বেশ সাদৃশ্য ছিল, তিনি অজন্তা গুহার কৃষ্ণ রাজকুমারীর কায়দায় সাজাতে ভালোবাসতেন নিজেকে। নিজের চেহারা সম্পর্কে তাঁর বিস্তর ভুল ধারণা ছিল। তিনি ভাবতেন, তাঁর অদম্য রূপ যৌবনের সামনে যে পুরুষই আসুক না কেন, সে তাঁর প্রেমে পড়ে যাবে। ১৯৪৬ সালে তিনি যখন তখন এলাহাবাদে ও দিল্লিতে নেহরুর বাসভবনে এসে উঠতেন। নেহরুর ঠিক পাশের ঘরটিতেই থাকার জন্য জেদ ধরতেন। নেহরু, ইন্দিরা ও নিজের জন্মদিন পালন করার জন্য পদ্মজা প্রত্যেক নভেম্বরের গোড়ায় হায়দরাবাদ থেকে নেহেরুর বাসভবনে উঠতেন। পদ্মজার এইভাবে যখন তখন আসা ও দীর্ঘদিন থাকা পছন্দ করতেন না ইন্দিরা। লেডি মাউন্টবাটন দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার পরে পদ্মজা একটু ঠান্ডা হলে আমি ওয়েস্টার্ন কোর্টে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। নানা কথার পরে তিনি আমাকে করুণ গলায় বললেন, জহর একটি মাত্র নারীর প্রণয়ী নয় ..”
এই লেখাতেই জানা যায়, পদ্মজা-নেহরু-ইন্দিরার সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনের কথা। পদ্মজা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে আসার নেপথ্য কাহিনীও বিশাল ও আকর্ষণীয়। সে প্রসঙ্গ থাক এখন। তবে বলে রাখা যেতে পারে, এই রাজ্যের প্রথম রাজ্যপাল তিনি ছিলেন না। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের প্ৰথম রাজ্যপাল ছিলেন। শেষ ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ছিলেন স্যার ফ্রেডরিক জন বারোস। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ওই রাজভবনে ছিলেন উনি। পদ্মজা ছিলেন চতুর্থ রাজ্যপাল এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র মহিলা রাজ্যপাল এই রাজ্যে। ১৯৫৬ র ৩ নভেম্বর তিনি রাজ্যপাল হন। প্রায় এগারো বছর তিনি ওই পদেই ছিলেন, ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। বিধান চন্দ্র রায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পদ্মজা, জহরলালের সঙ্গে ডাঃ রায়ের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল।
আজ যেমন মোদী-জগদীপ ধনখড়-মমতা ব্যানার্জির “মধুর সম্পর্ক”, তা সেদিন কিন্তু ছিল না। ফলে পদ্মজা বিধান রায়ের রোজ কাজিয়া হত না। পদ্মজা রাজভবনে আর বিধান রায় রাইটার্স বিল্ডিংসের ঠিকানায় নিজের নিজের মত থাকতেন। পদ্মজা যে দিল্লির থেকে অনেক দূরে মনের যন্ত্রণায় ছটফট করে রাজভবনের খাঁচায় বন্দিনী, বিধানবাবুর সে কথা জানা ছিল। জহরলাল ও পদ্মজা দুজনকেই তিনি নাম ধরে ডাকতেন। অবিবাহিত ডাঃ রায় এক ব্যর্থ প্রেমিকার দুঃখের প্রতি অনেকটা সহমর্মী ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে ।
পদ্মজা নাইডু ওই বিশাল প্রাসাদে একলা এক বিরহিনী এক বারান্দা থেকে অন্য বারান্দায় ঘুরে বেড়াতেন। অনেকটা সময় তাঁর কাটত বাগানে গাছেদের সঙ্গে। বহু দুর্লভ প্রজাতির লাল গোলাপ গাছ বসিয়েছিলেন। মালিদের বিশেষ যত্ন নেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ জহরলালের প্রিয় পুষ্প ছিল যে লাল গোলাপ। ব্যারাকপুরের রাজভবনে তিনি প্রায়ই চলে যেতেন। সেখানে তিনি করেছিলেন বিশাল এক বাগান। কতরকম লাল গোলাপ সেই বাগানে ফুটে থাকত। ওই বাগিচার নাম দিয়েছিলেন “জহর কুঞ্জ”। আজও সেই প্রেমের লাল গোলাপের উদ্যান আছে, কিন্তু আর ফোটে না গোলাপ।
দার্জিলিংয়ের রাজভবনের সঙ্গেও পদ্মজার কত দিন রাত কেটেছে। ব্রিটিশ ঘরানার ওই রাজভবন তৈরি হয়েছিল ১৮১৩ সাল নাগাদ। ইংরেজ লাটসাহেবদের অতি প্রিয় জায়গা ছিল এই পাহাড়ি এলাকা, কারণ বিলেতের মত ঠান্ডা আবহাওয়া। কলকাতার মত গরম নয়। সাহেবরাই চা চাষ শুরু করেন। বনজঙ্গল সাফ করে সুন্দর করে সাজাতে জাপান থেকে আনিয়েছিলেন পাইন গাছ। আজও সেই পাইন গাছ রয়েছে। চা বাগান আছে। পদ্মজার বসানো গোলাপের বংশধরদের দেখা মিলবে খোঁজ করলে।
সেদিনের মত সুন্দরী নয় আর দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং। লাভা , লোলেগাঁও , সুনতালখোলা , মিরিক সবই বদলেছে। একসময়ে এই রাজভবনের মাথার সেই গোল ডোমটির রঙও বদলে গেছে। নীল রং হয়েছে। কত পরিবর্তনের সাক্ষী এই রাজভবনটিও। সেই বাড়িতে গরমের সময় কলকাতা থেকে গিয়েছেন সব রাজ্যপালরা।
এখন যেমন ওই রাজভবনের বাসিন্দা জগদীপ ধনখড়। তিনি ওই ঐতিহাসিক রাজভবনে পুরো অফিস নিয়ে গেছেন। তাঁর কথায় এটা তাঁর আর একটা অফিস কলকাতার রাভবনের অফিসের মতোই। ছুটি কাটাতে নয়, কাজ করতেই একমাস থাকবেন। ঠিক এই সময়েই বিমল গুরুং আর বিনয় তামাংদের কাজিয়ায় পাহাড় গরম। সামনেই ভোট। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাজ্যপাল দার্জিলিংয়ে যাবার আগে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক সেরে নিয়েছেন। তিনি এই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার গোলা ছুঁড়েই চলেছেন।
রাজভবনের কাহিনী ইংরেজ আমল থেকেই বারবার নানা মোড় নিয়েছে। এখানে যাঁরা রাজ্যপাল হিসেবে বাস করেছেন সেই তালিকায় ২২ নম্বর জগদীপ ধনখড়। তাঁর পূর্বসূরীদের মধ্যে ১৯৬৭ তে ধরমবীর,১৯৮১তে ভৈরব দত্ত পান্ডে, ২০১০ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাপ্রধান এম কে নারায়ণন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন। এই রাজ্যে বাম জমানার শেষ ও তৃণমূল সরকারের গোড়ার দিকে রাজ্যপাল হিসেবে গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী ছিলেন এই রাজভবনের বাসিন্দা। কেশরী নাথ ত্রিপাঠীর পরে এখনও পর্যন্ত রয়েছেন জগদীপ ধনখড়। পর্যবেক্ষকদের মতে তিনিই এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সব থেকে সক্রিয় রাজ্যপাল। কলকাতা, ব্যারাকপুর ও দার্জিলিংয়ের তিন রাজভবনের প্রাচীন দেওয়াল, থাম, বারান্দা ও বাগানগুলি তিনশো বছর ধরে সব দেখেই চলেছে, আরো দেখবে কত!
ঋণ স্বীকার : মণীশ গুপ্ত (প্রাক্তন সাংসদ ও প্রাক্তন বিদ্যুৎ মন্ত্রী, দেবপ্রসাদ জানা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস), দীপক রুদ্র (অবসরপ্রাপ্ত আইএএস), নারায়ণ দাস (প্রবীণ সাংবাদিক), এম ও মাথাই-এর “নেহরুর সঙ্গে” ও ডেসমন্ড দোয়েগ।