ডা. পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার, চক্ষু চিকিৎসক
শ্যামল বাবুর সেদিন খুব মন খারাপ। অফিসেও গেলেন না। কিছুদিন ধরেই চোখ সংক্রান্ত একটা সমস্যায় ভুগছিলেন। সেটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা খচখচানি ছিলই। কিন্তু তেমন আমল দেননি। আজ হঠাৎ প্রতিবেশীর কথায় ভয় ধরে গেল। তাঁর কোন আত্মীয় নাকি কিছুদিন আগে এই কারণেই অন্ধ হয়ে গিয়েছেন। অস্থিরতার মধ্যেই কিছুটা সময় কাটালেন। অবশেষে আর থাকতে না পেরে ছুটে এসেছেন আমার চেম্বারে।
ঘরে ঢুকেই বিমর্ষ ভঙ্গিতে বললেন, “ডাক্তারবাবু, কয়েকদিন থেকে ডান চোখের সামনে মাছির মতো কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে। যেদিকে তাকাচ্ছি, মাছিটা সেদিকে সরে সরে যাচ্ছে। দূরের জিনিস দেখতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু বই পড়ার সময় কালো জিনিস বারবার মাঝখানে চলে আসছে। কি হলো বলুন তো এতে ভয়ের কিছু আছে নাকি? আমি কি অন্ধ হয়ে যাব?”
- দাঁড়ান, আগে আমাকে বুঝতে দিন। ব্যথা বা অন্য কোনো উপসর্গ আছে কি? আমি জানতে চাইলাম।
- না সেসব নেই। এমনকি চোখ থেকে জল পড়া, চুলকানো বা কটকট করা, এগুলো কিছুই হচ্ছে না।
ভালোভাবে পরীক্ষার পরে বুঝতে পারলাম শ্যামলবাবুর চোখে মারাত্মক কিছু হয়নি। ডাক্তারি ভাষায় একে বলা হয় ফ্লোটারস (Floaters)। আমাদের চোখের পিছনের প্রকোষ্ঠে থলথলে জেলির মতো এক ধরনের স্বচ্ছ জিনিস রয়েছে, যার নাম ভিট্রিয়াস হিউমর (Vitreous Humor)। স্বচ্ছ ভিট্রিয়াস হিউমরের মধ্যে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু ঘোরাফেরা করলে রেটিনার উপরে তার ছায়া পড়ে। তখন সেটাকেই চোখের সামনে কালো মাছের মতো মনে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিট্রিয়াস হিউমারের মধ্যে উপস্থিত এই ধরনের ছোট ছোট বস্তুর জন্য চোখের কোনও ক্ষতি হয় না।
শ্যামলবাবুকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করার জন্য বললাম, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। চোখের মাছির চিন্তা মন থেকে সরিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে মন দিন। আপনার মত অনেকেই চোখের সামনে কালো কালো বস্তু ভাসতে দেখেন। এই উপসর্গটির নাম Floaters। সাধারণত দিনের বেলায় উজ্জ্বল আলোতে অথবা যে কোনো সাদা প্রেক্ষাপটে যেমন, সাদা দেওয়াল, খোলা আকাশ, বইখাতার উপরে এগুলোকে বেশি দেখা যায়। অনেকে একই সঙ্গে বিভিন্ন আকারের একাধিক কালো দানার মত বস্তুকে ভাসতে দেখেন।
শ্যামলবাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হালকা গলায় বললেন, “কিন্তু যেদিকে তাকাই সেদিকেই মাছি সরে সরে যাচ্ছে যে।”
- বললাম যাচ্ছে যাক না।
- কিন্তু কেন যাচ্ছে সেটা তো বোঝাবেন।
- আগেই তো বলেছি আমাদের চোখে পিছনের প্রকোষ্ঠে যে থলথলে জেলির মত ভিট্রিয়াস হিউমর নামে স্বচ্ছ পদার্থ রয়েছে তার মধ্যে কোন অস্বচ্ছ বস্তু ঘোরাফেরা করলে, তার ছায়া রেটিনার উপর এসে পড়ে। সেই ছায়াটিকেই মাছির মত দেখায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভিট্রিয়াস হিউমর অপেক্ষাকৃত পাতলা হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অস্বচ্ছ বস্তুরা সহজেই ঘোরাফেরা করতে পারে অর্থাৎ যেদিকে তাকাবেন মনে হবে ছায়াটি সেই দিকেই রয়েছে।
শ্যামলবাবু জানতে চাইলেন, কিন্তু ভিট্রিয়াসের মধ্যে অস্বচ্ছ বস্তুর আসে কি করে? - নানা কারণে ভিট্রিয়াসের ভিতরে অস্বচ্ছ বস্তু জমা হতে পারে। বার্ধক্য, চোখে আঘাত, প্রদাহ, ডায়াবেটিস ইত্যাদির কারণে ভিট্রিয়াসের গঠনগত পরিবর্তনের ফলেই এমনটা হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। যাদের চোখের মাইনাস পাওয়ার রয়েছে, তাদের ভিট্রিয়াস অপেক্ষাকৃত পাতলা বা তরল হয়ে যায়। তাই মাইনাস পাওয়ারের লোকেদের এই মাছির সমস্যা খুবই স্বাভাবিক।
আইরাইটিস (Iritis), কোরোয়ডাইটিস (Choroiditis) ইত্যাদি প্রদাহজনিত অসুখে ভিট্রিয়াসের মধ্যে কিছু কিছু কোষ (Inflammatory Cell) ঢুকে পড়তে পারে। আবার ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ, রক্তের তঞ্চন-জনিত (Coagulation defect) সমস্যার ফলে কখনও কখনও ভিট্রিয়াসের মধ্যে রক্তপাত হয়ে থাকে। তবে কিছুদিন পরে ধীরে ধীরে সেই রক্ত শরীরের মধ্যে মিশেও যায়। কিন্তু কিছু কিছু জমাটবাধা রক্তকণিকা চোখের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। সেগুলিকেই মাছির মতো মনে হয়।
ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝতে পেরে শ্যামলবাবু বললেন, “তাহলে আর কি? আপনার চিকিৎসা শুরু করুন।”
হেসে বললাম, “ছোট মাছির জন্য সাধারণত কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না। তবে দিনের বেলায় বাইরে বেরোতে হলে রোদ চশমা ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। যাদের চোখের মাইনাস পাওয়ার রয়েছে, তাদের ফ্লোটারের সম্ভাবনা বেশি থাকার জন্য ফটোক্রোমাটিক অথবা পাওয়ার যুক্ত রোদচশমা পরা দরকার। এছাড়া চোখের প্রদাহ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি কারণগুলির যথাযথ চিকিৎসারও প্রয়োজন। ফ্লোটার আকারে ছোট এবং সংখ্যায় অল্প হলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা না করতে বা মনোযোগ না দিতে অনুরোধ করি।
অবশ্য মাছি সংখ্যায় যথেষ্ট বেড়ে গেলে বা একই সঙ্গে যদি চোখের সামনে আলোর ঝলকানি (Flash of light) দেখা দেয়, তবে সেটা চিন্তার বিষয়। সেটি নানা ধরনের জটিলতা পূর্বাভাস হতে পারে। সেক্ষেত্রে সাথে সাথে চোখের ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। আচ্ছা আমার চোখের এই মাছিটা একেবারে চলে যাবে তো? শ্যামলবাবুর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
না, তেমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই ভিট্রিয়াসের এই অস্বচ্ছ পদার্থগুলি থেকেই যায়। হয়তো বা পরিমাণে এবং আকারে একটু ছোট হতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময়ই রোগীরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং এই মাছিগুলির দিকে আর তেমন মনোযোগ দেন না।
নিশ্চিন্ত হয়ে শ্যামলবাবু এবার উঠে পড়লেন। বললাম, “কালকে অফিসে যাবেন কিন্তু।”
উনি হেসে বিদায় বিদায় নিলেন।