পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
সেই ছোটোবেলার ঝকঝকে চোখের দৃষ্টি কিংবা মধ্যবয়সের অল্প পাওয়ারের চশমা আর চল্লিশের চালশে নিয়ে কর্মজীবন সফল ভাবে শেষ করে সবে অবসর নিয়েছেন? অর্থাৎ বয়স ষাটের কোটায়? এতদিন আপনার চোখ বা দৃষ্টি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। হয়ত একটু অবহেলাই করা হয়েছে। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি অথবা সময়মত চশমার পাওয়ার চেঞ্জ করেননি। কারণ আপনার চোখে তো কোনো সমস্যাই নেই।
কিন্তু এবার সাবধান হতে হবে। কারণ আপনি এখন ষাটের কোটায়। বয়সের অনিবার্য প্রভাবগুলি একটু একটু করে ছাপ ফেলতে শুরু করবে আপনার নীরোগ শরীরে। কিন্তু একটু সচেতন আর সাবধান হলে, জীবনযাত্রায় ছককে একটা নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারলেই নীরোগ সুস্থ শরীরের আনন্দ আর দুচোখ ভরে পৃথবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
বয়স যখন ষাট পেরিয়ে যায়, কর্মজীবনের ব্যস্ততা আর কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তখন কিছু কিছু অনিবার্য পরিবর্তন শুরু হয় আমাদের শরীরে, দেহের কোষে কোষে। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ করবার ক্ষমতা কমে যায়, কমে যায় শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। আর তখনই নানা রোগব্যাধি গুটিগুটি পায়ে বাসা বাঁধে আমাদের শরীরে। এই সময়ে চোখের যে অসুখগুলি মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (ARMD), গ্লুকোমা, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, ড্রাইআই (Dry Eye) আর ক্ষীণদৃষ্টি (Low Vision)।
উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ চিকিৎসকের সহায়তায় ছানি আজকাল আর তেমন কোনও সমস্যা নয়। তবে সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা বা অপারেশন না করালে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। ম্যাকুলার ডিজেনারেশনে রেটিনার কোষগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে, যার ফলে দৃষ্টি একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যায়। এর চিকিৎসা বেশ জটিল আর ফলাফল অনিশ্চয়তায় ভরা। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে গ্লকোমার চিকিৎসা খুবই সন্তোষজনক। তবে গ্লকোমার ওষুধ সারাজীবন ব্যবহার করে যেতে হবে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে, রক্তের স্যুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে, উপযুক্ত চিকিৎসায় এই অসুখ থেকে অন্ধত্বকে রোধ করা যায়। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বাড়াবাডি অবস্থায় (Advanced Stage) প্রায় আর কিছুই করবার থাকে না। ড্রাইআই অসুখটি খুব বিরক্তিকর হলেও, চিকিৎসায় আশানুরূপ সাড়া পাওয়া সম্ভব।
ক্ষীণদৃষ্টি বা ল্যো-ভিশন সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এই অসুখে বইয়ের লেখা পড়া বা লেখালেখি করা, যা বয়স্ক লোকেদের অন্যতম অবলম্বন, তা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশার কালো ছায়া। কিন্তু এই অসুখের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ, এক্ষেত্রে রেটিনার নার্ভকোষগুলি এতই দুর্বল হয়ে যায় যে, সেগুলিকে আর পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই Low Visual Aid বা নানা ধরনের ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের সাহায্যে লেখাপড়ার কাজ চালানো হয়।
ষাটোর্ধ্ব বয়সে চোখ ভালো রাখবার ৮টি উপায় :
ডায়াবেটিস থেকে সাবধান
একথা প্রমাণিত যে, ডায়াবেটিস অন্ধত্বের অন্যতম কারণ। আর ৬০ বছর বয়সের পরে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এছাড়া স্থূলত্ব, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, উচ্চ রক্তচাপ, বেশি মিষ্টি জাতীয় খাবার, পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের ডায়াবেটিস ইত্যাদি কারণে রক্তের চিনির (শর্করা) মাত্রা বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের সূত্রপাত হয়। এই রোগে চোখের রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তজালিকা থেকে রক্তপাত শুরু হয়। রেটিনার নানা জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে তোলে। এই অবস্থার নাম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (Diabetic Retinopathy)।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক অবস্থায় রোগী কিছুই বুঝতে পারেন না। দৃষ্টির কোনও সমস্যাই থাকে না সেই সময়ে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রোগটা জটিল হয়ে ওঠে এবং রোগী যখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, ততদিনে দৃষ্টির যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে যায়। সুতরাং ৬০ বছর বয়সের পরে (বা তার আগে) ডায়াবেটিস ধরা পড়লেই, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্বাবধানে থাকা জরুরি।
ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন :
ডায়াবেটিসের মত হাই ব্লাড প্রেশারও চোখের শত্রু। এর ফলে রেটিনার রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। রক্তনালীগুলি সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে রক্তের অভাবে রেটিনার আলোক সংবেদী কোষগুলির কর্মক্ষমতা কমে যেতে থাকে। হাই ব্লাডপ্রেশারের দোসর রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশী থাকলে জমাট বাঁধা রক্ত (Thrombus) রেটিনার রক্তনালীর ভিতরে আটকে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। একে চোখের স্ট্রোক (Eye Stroke) বলা হয়। চোখের স্ট্রোকে দৃষ্টি ক্ষমতা মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধ হয়ে আংশিক বা সম্পূর্ণ অন্ধত্ব নেমে আসে। প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই আগেকার দৃষ্টি আর ফিরে আসে না। পারিবারিক ইতিহাস, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত জলপান, খাবারে লবণের আধিক্য, ধূমপান, মদ্যপান, শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা, অনিয়মিত জীবনযাপন ইত্যাদি হাই ব্লাডপ্রেশারের কারণ। তাই ৬০ বছর বয়সের পরে মাঝে মাঝেই ব্লাডপ্রেশার আর রক্তের সুগার ও লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করা উচিত।
দৃষ্টির সতর্কতামূলক পরিবর্তনগুলি খেয়াল রাখুন :
চোখের অনেক জটিল অসুখের সংকেত বা লক্ষণ আগেই পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা প্রথমে সেগুলিকে পাত্তা দিই না। চোখের এই মারাত্মক অসুখের প্রাথমিক রোগ লক্ষণগুলিকে যথাযত গুরুত্ব দিলে অনিবার্য অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সুতরাং নীচের লক্ষ্মণগুলি দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
১. ডাবল ভিশন (Double Vision) : ছানি, মস্তিষ্কের নার্ভের পক্ষাঘাত (Cranial Nerve Palsy), চোখের স্ট্রোক, Sjogren’s syndrome, ব্রেন টিউমার ইত্যাদি অসুখে কোনো কিছু দেখবার সময়ে একটা জিনিসকে দুটো দেখায়।
২. ঝাপসা দৃষ্টি (Hazy Vision) : ছানি, গ্লকোমা, Refractive Error, কর্নিয়ার ঘা, রেটিনাল ডিটাচমেন্ট, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ইত্যাদি অসংখ্য কারণে দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে। এক্ষত্রে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
৩. অল্প আলোয় দেখার অসুবিধা : ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, গ্লকোমা, রেটিনার রক্ত চলাচল-জনিত সমস্যা ইত্যাদি অসুখে অল্প আলোয় দেখতে সমস্যা হয়।
৪. চোখের ব্যথা : আইরাইটিস, গ্লকোমা, কর্নিয়াল অ্যাব্রেশন (Corneal Abrasion), চোখে ধুলোবালি বা কোনো বাইরের বস্তু (Foreign Body) ঢুকে গেলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
৫. লালা চোখ (Red Eye) : কনজাংটিভাইটিস, অ্যাকিউট গ্লকোমা, কনজাংটিভার হেমারেজ, আইরাইটিস ইত্যাদিতে চোখ লাল হয়ে যায়।
৬. আলোর ঝলক (Flash) : চোখের সামনে বিদ্যুৎ চমকের মত আলোর ঝলক দেখতে পেলে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে দেখিয়ে রেটিনার সামগ্রিক পরীক্ষা করা দরকার। নতুবা রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়ে চোখে চির- অন্ধকার নেমে আসতে পারে।
৭. ফ্লোটার বা কালো কালো বিন্দু (Floater) : চোখের সামনে মাছির মত কালো কালো বিন্দু ঘোরাফেরা করে। এদের চোখের মাছি বা ফ্লোটার বলে। বয়সের কারণে চোখের ভিট্রিইয়াস পাতলা হয়ে গেলে ফ্লোটার দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি থেকে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু কখনও কখনও এটি রেটিনাল ডিটাচমেন্টের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে। তাই সাবধানের মার নেই ।
পরিমিত শরীরচর্চা :
কর্মজীবন থেকে অবসর নেবার পরে অনেকেই একটু আলসে বা কুঁড়ে হয়ে যান। এর ফলেই শরীরে নানা সমস্যা বাসা বাঁধে। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ, পরিমিত শরীরচর্চা সমস্ত শরীরে এবং চোখে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। এজন্য ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ও অন্যন্য বার্ধক্যজনিত চোখের অসুখগুলির সম্ভাবনাও প্রায় ৭০% কমে যায়।
ক্ষতিকারক আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে সাবধান : সূর্যের আলোয় প্রচুর পরিমাণে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থাকে, যা শরীর এবং চোখের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এর প্রভাবে ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, পিঙ্গক্যুলা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। সেজন্য দিনের বেলায় বাইরে ঘোরাফেরা করবার সময় অবশ্যই ১০০ শতাংশ আল্ট্রাভায়োলেট সুরক্ষা যুক্ত সানগ্লাস পরা উচিত। মনে রাখা দরকার বাজার চলতি সাধারণ সানগ্লাসে বেশিরভাগ সময়েই আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকে না।
চোখ ভালো রাখার হাতিয়ার সুষম খাবার :
দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার দিকে নজর রাখুন। পুষ্টিকর সুষম আহার চোখের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, খাবারের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxident) ছানি ও রেটিনার অন্যান্য অসুখে খুবই উপকারী। ফলমূল ও টাটকা শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এছাড়া Omega-3 Fatty Acids ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের সম্ভাবনাকে অনেকটাই কমিয়ে দেয়। মাছ Omega-3 Fatty Acids-এর অন্যতম উৎস। সুতরাং রোজকার খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি, ফল এবং মাছকে স্থান দিতে হবে। আর অবশ্যই নিজের আহারটি রোজই নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করতে হবে।
বছরে অন্তত দুবার চোখ পরীক্ষা করা জরুরি :
বেশিরভাগ লোকেই অসুবিধা না হলে চোখের ডাক্তারের থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু এমন অনেক চোখের অসুখ আছে যারা খুব চুপিচুপি, প্রায় নিঃশব্দে চোখের দৃষ্টিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এবং মানুষ যখন তা টের পান, ততক্ষণে চিকিৎসা জটিল হয়ে সেরে ওঠবার সম্ভাবনাও কনেক কমে যায়। সেজন্য আপ্তবাক্য ‘Prevention is better than cure’ মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। বছরে কমপক্ষে দুবার চোখের সামগ্রিক পরীক্ষা করিয়ে নিন। অর্থাৎ চোখের পাওয়ার, আই ড্রপের সাহায্যে চোখের পিউপিল বড় করে রেটিনার পরীক্ষা, চোখের আভ্যন্তরীণ চাপ ইত্যাদি ভালোভাবে দেখে নেওয়া দরকার। এর ফলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, রেটিনার ছিদ্র, গ্লুকোমা, ম্যাকুলার কোনো সমস্যা থাকলে প্রথমেই ধরা পড়বে এবং উপযুক্ত চিকিৎসায় সহজেই রোগমুক্ত হওয়া সম্ভব।
ধূমপান নৈব নৈব চ
‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ তো বটেই, বোধহয় তা আমাদের চোখের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ধূমপানের সুখ উপভোগ করতে গিয়ে চোখের যে অসুখগুলিকে ডেকে আনা হয়, সেগুলির মধ্যে ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (AMRD), ইউভিয়াইটিস (Uvitis) ইত্যাদি অন্যতম। ধূমপানের ফলে (এমনকি Passive Smoking-এও) রক্তনালীর সঙ্কোচন, রক্ত প্রবাহের ঘাটতির কারণে চোখে প্রয়োজনীয় রক্তচলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং ধূমপান বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।
এই সামান্য কয়েকটি সাধারণ ব্যাপার মেনে চললে সারাজীবন উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব।
আরও জানতে Email করুন : pbsarkar@gmail.com
অথবা Whatsapp : 9830606220