হোমদেশজামসেতজি নাসেরওয়ানজি টাটা: আধুনিক ভারতের শিল্পায়নের প্রথম পথিকৃৎ

জামসেতজি নাসেরওয়ানজি টাটা: আধুনিক ভারতের শিল্পায়নের প্রথম পথিকৃৎ

জামসেতজি নাসেরওয়ানজি টাটা: আধুনিক ভারতের শিল্পায়নের প্রথম পথিকৃৎ

bikash palবিকাশ পাল, ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডন

“আজ যে দেশের ইস্পাত আছে কাল সে দেশ সোনার অধিকারী হবে”, ১৮৬০-এর দশকের কোন এক সময় ইংরেজ দার্শনিক-লেখক টমাস কার্লাইল ম্যাঞ্চেষ্টারে এক ভর্তি সভাঘরে শ্রোতাতাদের উদ্দেশে একথা বলেছিলেন। কথাটা বছর পঁচিশের এক তরুণ ভদ্রলোকের মনে বেশ ধরল। তখন থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করলেন, তাহলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, আগে দরকার ইস্পাত শিল্পের। শ্রোতাদের মধ্যে বসে থাকা সেদিনের সেই তরুণ ভদ্রলোক আর কেউই নন। তিনি জামসেতজি নাসেরওয়ানজি টাটা (Jamsetji Nusserwanji Tata), আধুনিক ভারতের শিল্পায়নের প্রথম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ৩ মার্চ। জন্মদিনে তাঁকে আমার নত মস্তকে প্রণাম। ১৮৩৯ সালে দক্ষিণ গুজরাতের নাভসেরিতে তাঁর জন্ম।

১৯৯১ সাল। আমি তখন ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স (আই আই এস সি)-এ পড়াশোনা করি। সেখানে ৩ মার্চ খুব ধুমধাম করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হল। হস্টেলে দারুণ খাওয়া-দাওয়াও হল। সেই প্রথম জানলাম, এই দিনটিতে জামসেতজি জন্মেছিলেন। তাঁর বাবা নাসেরওয়ানজি তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের আমদানি রপ্তানির ব্যবসার প্রসারের জন্য। সেটা ১৮৬০-এর দশকের শুরুর দিকে।

তাঁর কাজ ছিল ইংল্যান্ডের নানান উদ্যোগপতির কাছে যাওয়া আর তাঁদের কথা শোনা। দাদাভাই নওরজি তখন লন্ডনেই থাকতেন। তিনি জামসেতজির বাবার বন্ধুস্থানীয়। তাই বিদেশ বিভুঁইয়ে তিনিই তাঁর পরামর্শদাতা। বিলেতের এক শহর থেকে অন্য শহরে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ট্রেনে বা অবসর সময়ে তাঁর সঙ্গী চার্লস ডিকেন্স আর মার্ক টোয়েনের লেখা বই। ল্যাঙ্কাশায়ারে কাপড়ের কলকারখানা ঘুরে ঘুরে দেখতেন। এইভাবে বছর চার কেটে গেল। অনেক মানুষের সাথে কথা হল। অনেক কিছু জানা হোল, শেখাও হোল। অবশেষে দেশে ফিরলেন।

কার্লাইলের কথাটা ভালো লেগেছিল ঠিকই, তবে ইস্পাত কারখানা নিয়ে তাঁর অত তাড়াহুড়ো ছিল না। তাছাড়া দেশে ফিরে তাঁর অনেক অন্য কাজ করার পরিকল্পনা ছিল। মূলত বস্ত্র শিল্প। শুরু হল নাগপুরে এম্প্রেস মিল, বোম্বেতে স্বদেশি মিল। মাঝে মাঝে ইংল্যান্ড আমেরিকা যেতে শুরু করলেন উন্নততর প্রযুক্তির জন্য। মিশরের মত উন্নত মানের তুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক চাষ শুরু করলেন দেশেই। দেশে তিনিই প্রথম চালু করলেন কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড। আন্ধেরি, কুরলা, বান্দ্রা, জুহু, সান্তাক্রুজকে ঘিরে যে বিরাট জলা জমি ছিল, তার ১২০০ একর মত কিনে সেটাকে উন্নত করার কাজও করেছিলেন জামসেতজি। তাই আজকের জুহু বান্দ্রার এই অংশের রূপকার তিনিই। পরে সেসব সম্পত্তি নগর উন্নয়ন দপ্তর তাঁর থেকে অধিগ্রহণ করে।

জামসেতজি দেখলেন মাইসোরের সিল্কের তখন অস্তিত্বের সংকট চলছে। হায়দার আলি, টিপু সুলতানদের সময় যে শিল্পের এত জগতজোড়া খ্যাতি ছিল, ব্রিটিশ শাসকদের দীর্ঘ অনাদর আর অবহেলায় সেই খ্যাতির প্রদীপের শিখা তখন ক্ষীণ হয়ে জ্বলছে। এই শিল্পের হৃতগৌরব ফেরানোর জন্য জামশেদজি জাপান থেকে বিশেষজ্ঞ এনে উন্নত পদ্ধতিতে গুটিপোকা আর মালবেরি গাছের চাষের ব্যবস্থা করলেন। পরে সেটাও সেখানকার প্রাদেশিক সরকারকে সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালনা করতে বললেন। ঐতিহ্যসম্পন্ন একটা শিল্প আর তার সাথে যুক্ত মানুষের একটা রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মুনাফা নয় ।

১৮৯০-১৯০৪
ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)

১৮৯০-এর দশকের শুরুতে তিনি ইস্পাত শিল্প নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন। দাদাভাই নওরজিকে বললেন পঞ্চাশ পেরিয়ে নতুন যা কিছু করবেন তা শুধু দেশের কথা ভেবে। তিনি ভাবলেন কলকারখানার দূষণের হাত থেকে বোম্বাইয়ের নাগরিক জীবন আর জনপদকে রক্ষা করতে চাই দূষণহীন জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। জামসেতজি প্রযুক্তির জন্য গেলেন আমেরিকার নায়াগ্রা ফলস দেখতে। এম্প্রেস ইন্ডিয়া জাহাজে চলেছেন জাপানের ইয়কহমা থেকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার। জাহাজের কেবিনে দেখা হল স্বামী বিবেকানন্দর সাথে। জামসেতজি যোগ দেবেন শিকাগো ওয়ার্ল্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফেয়ারে, আর সেখানেই স্বামীজি চলেছেন বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে।

জামসেতজির ইস্পাত শিল্পের পরিকল্পনা শুনে স্বামীজি ভীষণ খুশি হয়ে বললেন, ভারতে ধর্মের অভাব নেই, কিন্তু মানুষের খাবারের অভাব আছে। বেশির ভাগ বাড়িতে পুরুষেরা ভাত পেলেও মেয়েরা ভাতের ফ্যান খেয়ে থাকে। আর যে বছর অনাবৃষ্টি হয়, সে বছর অনাহারের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তিনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পায়ে হেঁটে ঘুরে এসব নিজের চোখে দেখেছেন। তাই কর্মসংস্থান জরুরি – যার ভিত্তি হবে শিল্প, যাকে চালিত করবে ফলিত বিজ্ঞান শিক্ষা।

স্বামীজি জানতে চাইলেন, এত বড় কারখানাতে উন্নত প্রযুক্তিতে ইস্পাত উৎপাদন হবে, সেই কাজের জন্য অনেক পশ্চিমের মত পেশাদার মানুষের দরকার। সে সব আসবে কোথা থেকে? সেখান থেকে জামসেতজি ভাবতে শুরু করলেন, একটি সায়েন্স আর টেকনোলজি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কথা। এই হল আইআইএসসি প্রতিষ্ঠার প্রথম ভাবনা। পরে স্বামীজি প্রবুদ্ধ ভারতে লিখেছিলেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিল্প আর প্রযুক্তি বিজ্ঞান চর্চার এত বড় উদ্যোগ জামসেতজির আগে আর কোনও ভারতীয় কখনও নেননি।

আইআইএসসি শুরু হতে অনেক সময় লেগেছে। এ জন্য জামসেতজিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। স্বামীজি শিকাগোতে বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ব জয় করেছেন। তাঁর কথা দেশের রাজা মহারাজা আর শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় – সকলেই গুরুত্ব দিয়ে শোনেন। স্বামীজিকে চিঠি লিখে জামসেতজি অনুরোধ করেন, দেশে এ ব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার জন্য। স্বামীজি তখন বেলুড় মঠ স্থাপনের জন্য অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত। তাছাড়া তাঁর শরীরে নানান উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাই তাঁর পক্ষে জামসেতজির অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ভাইসরয় লর্ড কার্জন অনুমোদনও দেননি।

জামসেতজি তার মোট সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দেওয়ার আইনানুগ প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও কার্জন কর্ণপাতই করেননি। ১৯০০ সালের শেষের দিকে ইংল্যান্ড থেকে নোবেলজয়ী লর্ড রামসে (কেলভিন) জামসেতজির অনুরোধে ভারতে এসে কয়েকটি জায়গা পরিদর্শন করে ব্যাঙ্গালোরকে পছন্দ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে।

অবশেষে ১৯০১ সালের শেষের দিকে লন্ডনে ইন্ডিয়া সেক্রেটারি অফ স্টেট, লর্ড হ্যামিলটনের সাথে দেখা করে জামসেতজি ইস্পাত আর আইআইএসসি-র অনুমোদনের জন্য দরবার করেন। হ্যামিলটনের নির্দেশে কার্জন কিছুটা আগ্রহী হন। পরে আবার বেঁকে বসেন। ১৯০৩ সালের শেষের দিকে জামসেতজি লন্ডনে হ্যামিলটনের সাথে আবার দেখা করে ভারত সরকারের আর্থিক অনুমোদন চান। হ্যামিলটন আশ্বাস দেন। আবার শুরু হয় কার্জনের থেকে আর্থিক অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা। তার কয়েক মাস পরে ১৯০৪ সালের ১৯ মে জার্মানিতে চিকিৎসা চলাকালীন জামসেতজি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। জামসেতজির দুই ছেলে দোরাবজি আর রতনজির চেষ্টায় পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড মিন্টো আর্থিক অনুমোদন দেন। ১৯০৯ সালে আইআইএসসি-তে প্রথম পঠন-পাঠন শুরু হয়। ১৯১১ সালে চালু হয় ইঞ্জিনিয়ারিং। এই প্রতিষ্ঠানে পড়েছি ভাবলেই গর্ব বোধ করি।

টাটা স্টিল
জামসেতজি আমেরিকার স্টিল টাউন ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তাঁর সঙ্গে থাকতো, ব্যাগভর্তি দেশের নানান জায়গা থেকে সংগ্রহ করা আকরিক লোহা আর কয়লার খণ্ড। উদ্দেশ্য কোন আকরিকে সবচেয়ে বেশি ইস্পাত পাওয়া যাবে, কোন কয়লা সব চেয়ে বেশি উপযুক্ত কোকিং কোল হিসেবে, এসব সে দেশের বিশেষজ্ঞদের থেকে জানা। কারনিগি, জে পি মরগ্যান তখন সে দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রতিষ্ঠিত সব নাম। ১৯০২-এর নভেম্বেরে আমেরিকান ইস্পাত-শিল্প পরামর্শদাতা জুলিয়ান কেনেডির সাথে দেখা করলেন। কেনেডি পরামর্শদাতা কিন্তু ইস্পাত বিশেষজ্ঞ নন। তিনি জামসেতজিকে পাঠালেন হার্ভার্ডের ধাতুবিদ্যায় গ্রাজুয়েট চার্লস পেগিন পেরিনের কাছে।

চার্লস পেরিন এক বিরাট ইঞ্জিনিয়ার, আবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির চাম্পিয়ান রোয়িং টিমের ক্যাপ্টেন। টেকনোলজি আর স্পোর্টস সবেই তিনি আগ্রহী -খুব কর্মকুশলী। প্রথম দিনের আলাপচারিতাতেই পেরিন, জামসেতজির মধ্যে সৎ , নম্র অথচ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্পে দৃঢ় এক মুক্তমনের মানুষের পরিচয় পেলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, এই দূরদর্শী মানুষটিকে তিনি সাহায্য করবেন। পেরিন তাঁর পার্টনার সি এম ওয়েলডকে ১৯০৩ এর জানুয়ারিতেই ভারতে পাঠালেন।

ওয়েলড মধ্যপ্রদেশের চান্দা জেলা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। দেখলেন খুব আকরিক রয়েছে, মান ভালো, তবে এক লপ্তে নেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে আছে। তাঁর কাজ শেষ। পেরিনকে চিঠিতে জানালেন, ভারতে কয়েক সপ্তাহ বেড়িয়ে আমেরিকা ফিরে আসছেন। পেরিনের থেকে পাওয়া জবাবি চিঠিতে জানতে পারলেন, টাটা মুনাফার জন্য ইস্পাত শিল্প বানাতে চান না। দেশকে শিল্পনির্ভর করে তুলতে চান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছেন। দোরাবজিও ওয়েলডকে একথা বলতেন। তাই আমেরিকা ফিরে না গিয়ে ভারতে থাকার মেয়াদ বাড়িয়ে নিলেন তাঁদের কথায়।

এবার ওয়েলড আর দোরাবজি দ্রুগ জেলার ধলহারা পাহাড়ে গেলেন। একদিন দোরাবজি নাগপুরে কমিশনারের অফিসে মিটিং করার জন্য পাশের মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করছেন। সেখানে দেওয়ালে একটি দেশের খনিজ মাপে তাঁর চোখ পড়ল। লাইব্রেরিয়ান বললেন, এই মাপের সাথে একটা রিপোর্ট আছে স্যার। দোরাবজি দেখলেন, প্রমথ নাথ বোস নামের বিলেত ফেরত এক বাঙালি ভূতত্ত্ববিদের সুন্দর রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, ওড়িশার মহানদীর অববাহিকাতে অনেক উন্নত মানের লৌহ আকরিক আছে। লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে দোরাবজি জানতে পারলেন মিঃ বোস ময়ুরভঞ্জের মহারাজার এস্টেটে কর্মরত।

ইতিমধ্যে জামসেতজি ছেলে দোরাবকে আমেরিকা থেকে লিখলেন, তিনি সে দেশের স্টিল টাউনগুলি দেখে বেশ হতাশ। কারখানায় মানুষকে মুনাফার মুল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের পারিবারিক সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ব্যবস্থা নেই, কারখানার চৌহদ্দি বা তার সংলগ্ন কোনও কলোনি এলাকায়। দোরাবকে লিখলেন, ইস্পাত কারখানার জায়গা ঠিক করার সময় যেন খেয়াল থাকে, অনেক ফাঁকা জমির দরকার। ফুটবল, হকি খেলার মাঠ, স্কুল, রেসিডেন্স ব্লক, পার্ক, পাশাপাশি মন্দির মসজিদ আর গির্জার জন্য খোলা জায়গা থাকা চাই। তিনি জরস্ত্রিয়ান হয়েও কত অসাম্প্রদায়িক, সেটা তাঁর এই চিঠির বক্তব্য থেকে বোঝা যায় ।

দ্রুগে ধলহারা পাহাড়ের আকরিক উন্নত মানের কিন্তু ভালো কোকিং কয়লা আশেপাশে নেই। তাই এবার গন্তব্য ময়ূরভঞ্জ। আমেরিকা থেকে মিঃ পেরিন এসে গেলেন। সেখানে মিঃ বোসের সাথে দেখা করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন খোঁজে। সঙ্গে নিলেন টাটা গ্রুপের আর এক অফিসার শ্রীনিবাস রাওকে। কোনোদিন হাতির পিঠে চড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে, কোনোদিন ঘোড়ার গাড়ি করে বারিপাদার গরু মাহিসানি পাহাড়ের আশেপাশে, এভাবেই চলল। ভাল আকরিক পাওয়া গেল তবে আরও অনেক কিছুর অভাব। দুর্ভাগ্যবশত ১৯০৪ সালের মে মাসে জামসেতজিও মারা গেলেন। দোরাবজি তখন জার্মানিতে। মিঃ পেরিন আর ওয়েলড ভাবছেন কি করা যায়। তবে হাল ছাড়লেন না।

জামসেতজির স্বপ্ন তখন তাঁদেরও স্বপ্ন। এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। একদিন মিঃ ওয়েলড আর মিঃ রাও ছুটির দিনে ঘোড়ায় চড়ে সুবর্ণরেখা নদীর চরে ঘুরে বেড়ানোর সময় নদীর জলে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন। সাকচি গ্রামে খরকাই নদী ঠিক সুবর্ণরেখার সাথে যেখানে মিশেছে, সেখানে জলের মাঝ বরাবর এক লম্বা লাল দাগ। মিঃ ওয়েলডের ধারণা হল, জলের নীচের জমি থেকে লাল হেমাটাইট জলের স্রোতে ধোয়া হয়ে আসছে। পরের দিন দলবল নিয়ে তাঁবু ফেলে রিভার বেড পরীক্ষা করা হল। মিঃ ওয়েলড নিশ্চিত হলেন, এত দিন যা খুঁজছিলেন, সেটা এখানেই আছে। মিঃ বোস জানালেন, ঝরিয়া আর রানিগঞ্জের কয়লার গুনগত মান বেশ ভাল আর খুব একটা দূরেও নয়। সাকচির লোহার আকরিক, ম্যাঙ্গানিজ, লাইম স্টোন, সুবর্ণরেখার জল, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের কালিমাটি রেল স্টেশনের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগ। আর কী চাই! সিদ্ধান্ত হল এখানেই হবে দেশের প্রথম ইস্পাত কারখানা ।

পেরিন ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কাছে টাটার হয়ে ইস্পাত কারখানার অনুমোদনের জন্য গেলেন। সরকারের রিভিউ কমিটির সদস্য ইন্ডিয়া রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার ফেডেরিক আপকট সরকারকে রিপোর্ট দিলেন। তিনি লিখলেন, টাটার তৈরি স্টিল যদি ব্রিটিশদের ঠিক করে দেওয়া গুণগত মানকে ছুঁতে পারে, তাহলে তিনি টাটারা যত স্টিল বানাবেন, তার সব নিজেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবেন। ১৯১২ সালে কারখানা চালু হল। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। এই কারখানা থেকে ১৫০০ মাইল রেল লাইনের পাত সরবরাহ হল। উত্তর আফ্রিকার নানান দেশ আর মিশরে রেলের লাইন পাতা হল। সেজন্য তখনকার ব্রিটেনের ব্রিটিশ সরকার দোরাবজিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি দিলেন। দোরাব আর রতনজিকে স্যার খেতাব দেওয়া হোল। মিঃ পেরিন আর দোরাবজি নিজেদের মধ্যে রসিকতা করে বলতেন, যেভাবে স্টিল উৎপাদন হচ্ছে, তার সব যদি স্যার ফেডেরিক তাঁর প্রতিশ্রুতি মত খাওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁর কিছুটা বদহজমের সম্ভাবনা আছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের কয়েক বছর পর ভাইসরয় স্যার মন্টেগু চেমসফোর্ড কালিমতি স্টেশনের নাম পাল্টে করলেন টাটানগর। আর পুরো এলাকার নাম হল জামশেদপুর। ভারতবর্ষের মধ্যে এ আর এক ভারতবর্ষ। এখানে বিহারি, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, গুজরাতি, বাঙালি, পাঞ্জাবি-শিখ, হিন্দু-মুসলিম, সবাই কাজ করে আসছেন সেই ১৯১২ সাল থেকে। এখন প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষের বসবাস। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরদ্বয়ারা, সবই আছে জামশেদপুরে। জামসেতজি তো এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। এই হল টাটা স্টিলের শুরুর ইতিহাস।

তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরে জামসেতজি দেশের জন্য চারটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, আইআইএসসি, ইস্পাত কারখানা আর পশ্চিম ঘাটে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এর মধ্যে একমাত্র হোটেলটি তিনি দেখে যেতে পেরেছেন। বাকি সব তাঁর চলে যাওয়ার পরে হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে কি করে সম্ভব? অনেকের মতো আমারও ধারণা, এটা সম্ভব হয়েছে এই জন্য যে, তিনি এই কাজগুলির জন্য সঠিক লোক খুঁজে বের করেছিলেন, আর তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন। দোরাবজি, রতনজি, দাদাভয় টাটা, পি এন বোস, শ্রীনিবাস রাও, বেজনজি মেহতা, বুরজরি পাদশাহ, চার্লস পেরিন, সি এম ওয়েলড – এঁদের সবার মধ্য দিয়েই তিনি শিল্পে আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। চার্লস পেরিন ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত বহুবার জামশেদপুরে এসে বহুদিন ধরে টাটা গ্রুপকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

বিটেলসের জন লেনন বলেছিলেন, একা একা স্বপ্ন দেখলে, সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়, একসাথে স্বপ্ন দেখলে তা বাস্তবায়িত হয়। এসব লিখতে লিখতে রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলির একটি কবিতা মনে আসছে।
“ভেবে ছিলাম বিজন ছায়ায়
নাই যেখানে আনাগোনা,
সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায়
সেথায় হবে জানাশোনা ।
অন্ধকারে একা একা
সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা,
ডাকো তোমার হাটের মাঝে
চলছে যেথায় বেচা কেনা‌।”

জামসেতজি দেশকে ভালবেসেই এই কাজগুলি করে গেছেন। মানুষকে বাদ দিয়ে তো দেশ হয় না, তাই মানুষকে তাঁর কর্মযজ্ঞে যুক্ত করেছিলেন।

ইংল্যান্ডের ব্রুকউড সেমেট্রি বাঁদিক থেকেঃ দোরাবজি-মেহেরবাই, জামসেতজি, রতনজি-নাভাজবাইদের সমাধিস্থল

উইপ্রোর কর্ণধার আজিম প্রেমজি বলেছিলেনঃ জামসেতজি একজন মানুষ যিনি দেশকে আত্মবিশ্বাসী হতে শিখিয়েছেন। জামসেতজির শিল্প উদ্ভাবনী শক্তিকে তিনটি সহজ জরস্ত্রিয়ান শব্দ আজীবন চালিত করেছে। সেগুলি হলঃ Humata (সুচিন্তা) Hukhta (সুবাক্য) and Huvarasta (সুকর্ম)

জরস্ত্রিয়ানদের অবতারপুরুষ আহুরা মাজদার বাণী হিসেবে এটি প্রচলিত। খ্রিস্ট্রপূর্বের পারস্যের ইতিহাস পড়ে জেনেছিলাম, আহুরা মাজদার আশীর্বাদ ছিল এই ধর্মের আরকমেনিয় রাজা সাইরাসের ওপর। এজন্য পারস্যের এই সময়ের ইতিহাস সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস। এই রাজার একমাত্র চিন্তা ছিল প্রজাদের মঙ্গল। আমি রাজার রাজধানী অধুনা ইরানের ফারস প্রদেশের পাসারগড়ে তাঁর সমাধিস্থল আর পার্সিয়াপোলিশের রাজদরবারের কীর্তি স্তম্ভে আমার প্রণতি জানিয়ে এসেছি কয়েক বছর আগে।

জামসেতজির পূর্বপুরুষরা প্রায় ১২৫০ বছর আগে গুজরাতে এসেছিলেন। তাঁরা ঐ ফারস প্রদেশের পার্সিয়াপোলিশে অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। তাই এঁদের পার্সি বলা হয়। নাভসেরিতে ছোট জামসেতজি জরস্ত্রিয়ান আদর্শব্রত আনুষ্ঠানিক ভাবেই গ্রহণ করেন পারিবারিক প্রথা হিসেবে। আমার ধারণা, সেটাই আজীবন তাঁর কর্ম ও জীবন চেতনাকে সম্পৃত্ত করেছে।

লন্ডনের উপকণ্ঠে আমার বাড়ির থেকে ২৫ মাইলের মধ্যেই বিখ্যাত ব্রুকউড সেমেট্রি। এটির বিশেষত্ব, এটি বিশ্বের সব ধর্মের মানুষের জন্য। এখানেই জামসেতজি, আর তাঁর দুই পুত্র, পুত্র বধূ ও তাঁর পরিবারের অনেকেই চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। আমি বছর ৩-৪ আগে এঁদের সমাধিস্থলে আমার বিনম্র প্রণাম জানাতে গিয়ে এই ছবিটি নিয়েছিলাম। সেখানেও দেখলাম সমাধি ফলকের দরজায় ফার্সিতে খোদিত আছেঃ Humata (সুচিন্তা) Hukhta (সুবাক্য) and Huvarasta (সুকর্ম)

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img