মোশারফ হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক
রাজীব গান্ধী হ্যাজ বিন অ্যাসাসিনেটেড অ্যাট শ্রীপেরামপুদুর….। মাত্র একটি বাক্য। একটি নিউজ এজেন্সির পাঠানো ওই একটিমাত্র বাক্য সেইমাত্র উগরে দিয়েছে টেলিপ্রিন্টার। দিনটা ছিল ২১ মে, ১৯৯১। রাত সাড়ে এগারোটার খানিক পরে। দিনকয়েক বাদেই লোকসভার ‘অকাল ভোট’ ভোট হওয়ার কথা। মাত্র দু’বছর আগে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেসকে হারিয়ে মাণ্ডির রাজাসাহেব বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংয়ের নেতৃত্বে দিল্লিতে নতুন সরকার শপথ নিলেও বিজেপি’র সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে তা অকালেই ধসে পড়ে। মনোমালিন্যের বিষয় ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির ইস্যু। লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা। করসেবা।
তারপরও সমাজবাদী নেতা চন্দ্রশেখরকে প্রধানমন্ত্রী করে দিল্লিতে সরকার রক্ষার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের বেশি টেকানো যায়নি। সেকারণেই ফের ভোট। দেশজুড়ে রাজনৈতিক ব্যস্ততা তুঙ্গে। দু’বছরের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়ে ফের ময়দানে নেমে পড়েছেন রাজীব। তিনিই ফের ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে যাবেন এমন জল্পনা চলছে। দলের হয়ে প্রচারে গোটা দেশে চক্কর কাটছেন।
মাত্র পাঁচদিন আগে কলকাতা ঘুরে গেছেন। বেশ কয়েকটা প্রচারসভা ও কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক। আমাদের প্রেস ক্লাবের পরিভাষায় ‘মিট দ্য প্রেস’। ওইদিন অর্থাৎ ১৬ মে দুপুর থেকেই আমি কলকাতা প্রেস ক্লাবে উপস্থিত ছিলাম। একজন সাংবাদিক হিসেবে তো বটেই, প্রেস ক্লাবের একজন কর্মকর্তা হিসেবেও।
প্রেস ক্লাবের পরিচালন কমিটির সদস্য। ট্রেজারার। ক্লাবের প্রথা অনুযায়ী মিট দ্য প্রেসের পর অফিস রুমে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে রাজীব গান্ধীকেও চা-পানে আপ্যায়ন করা হচ্ছিল। ওই পর্বে বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে কেবল ক্লাব পরিচালন কমিটির সদস্যরাই অংশ নেন। ঘটনাচক্রে সেই চা-পর্বে আমি রাজীবের পাশের চেয়ারেই বসেছিলাম। প্রচণ্ড গরমেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর গলায় একটা সিল্কের স্কার্ফ জড়ানো। বললেন, গলায় ব্যথা। একটু গরম জল পেলে ভালো হয়। গরম জল আসার পর চুমুক দিচ্ছিলেন।
সেইসময় ক্লাবের একমাত্র ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। হাতের কাছে হওয়ায় আমি তুললাম। টেলিফোনের ওপ্রান্তে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি। সেবার হাওড়া থেকে ভোটে লড়ছেন। সম্ভবত তাঁর কাছে খবর ছিল রাজীব তখন ক্লাবেই রয়েছেন। অনুরোধ করলেন ফোনটা তাঁর হাতে দিতে। আমি বিষয়টি রাজীবকে জানালাম। উনি বললেন, প্রিয়কে বলে দিন আমি আগে দেশপ্রিয় পার্কে মমতার প্রচারসভায় যাবো, তারপর হাওড়ায়। প্রিয়বাবুকে জানালাম। তিনি তবুও নাছোড়। একবার রাজীবজির সঙ্গে কথা বলাতেই হবে। তা শুনে রিসিভার হাতে নিয়ে প্রিয়বাবুকে রাজীব বললেন, দাসমুন্সি, আমি তো তোমাকে আগেই বলে দিয়েছি, মমতা ইজ প্রয়োরিটি। ওর মিটিংয়ের পর তোমারটায় যাবো। সে যত রাতই হোক না কেন!
উল্লেখ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেবার কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর আগে জীবনে প্রথমবার লোকসভা ভোটের লড়াইয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন যাদবপুর কেন্দ্র থেকে। সেটা ১৯৮৪ সাল। একবারে আনকোরা হলেও সেবার তিনি সিপিএমের হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বিপুল ভোটে পরাজিত করে লোকসভায় পৌঁছেছিলেন। প্রথমবারের সাংসদ হলেও বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়ে সংসদে অনেকেরই নজরে পড়েছিলেন। স্বয়ং দলনেতা তথা প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও বাংলার ওই দাপুটে নেত্রীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু পাঁচ বছর বাদে ওই কেন্দ্রেই পরাজিত হন। সেবার অবশ্য সোমনাথবাবু যাদবপুরে দাঁড়াননি।
এরপর ১৯৯১ এর ভোটে কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাদবপুরের বদলে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে প্রার্থী করে। সেদিন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রেস ক্লাব থেকে বিদায় নিলেন। এর আগে অত কাছ থেকে রাজীব গান্ধীকে দেখা বা তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। সুন্দর চেহারা তো ছিলই, ব্যবহারটাও ভারী মিষ্টি লাগল। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আর ক’দিন বাদে তো এই মানুষটিই ফের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ভালোই হবে। কিন্তু মাত্র পাঁচদিন বাদেই সব ওলটপালট হয়ে গেল।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেই ২১ মে আমার নাইট ডিউটি ছিল। সিনিয়র রিপোর্টার পদে প্রমোশন পেলেও তখনও সপ্তাহে একদিন নাইট ডিউটি করি। মোটামুটি প্রতি মঙ্গলবার। আমাদের ‘বর্তমান’ পত্রিকার অফিস তখন মৌলালির কাছে জোড়া গির্জার উল্টোদিকে ৭৬এ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোডে। লালরঙের দোতলা বাড়ি। একতলায় প্রেস। দোতলায় বাকি সমস্ত বিভাগ। নিউজ রুমের মধ্যে একদিকে নিউজ ডেস্ক। অন্যদিকে একটু ছড়ানো ছিটানোভাবে রিপোর্টারদের বসার জায়গা। চিফ রিপোর্টার ও নিউজ এডিটরের টেবিল প্রায় মুখোমুখি।
নিউজ ডেস্কের কাছকাছি কাচ ঘেরা ছোট্ট একটা জায়গায় টেলিপ্রিন্টার ও টেলেক্স মেশিন। সারাদিন টকর টকর আওয়াজ তুলে বিভিন্ন এজেন্সির পাঠানো খবর উগরে দেয়। ম্যাড়ম্যাড়ে কাগজের লম্বা লম্বা রোল মেশিন থেকে সেইসব খবর বুকে এঁকে বাইরে আসে। সময়মতো ছিঁড়ে না নিলে বাড়তে বাড়তে একসময় মেঝের ওপর গড়াগড়ি খেতে থাকে। বিকেল বা সন্ধ্যার তুলনায় রাতের দিকে এরকম ঘটনা একটু বেশিই ঘটে।
রোজই ন’টা সওয়া ন’টা থেকে নিউজ রুম খালি হতে শুরু করে। দশটা নাগাদ চিফ রিপার্টার, নিউজ এডিটর, আফটারনুন বা ইভিনিং শিফটের সাব এডিটররাও বেরিয়ে যান। কোনও বিশেষ কারণ না ঘটলে তারপর রিপোর্টিং বিভাগের প্রতিনিধি বলতে একমাত্র নাইট রিপোর্টার ও অন্যদিকে নিউজ ডেস্কের কয়েকজন থাকেন। এটাই দৈনিক রুটিন।
তখনও টিভি বলতে একমাত্র দূরদর্শন। তার সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ বুলেটিন মধ্যরাতের অনেক আগেই। কিন্তু প্রভাতী খবরের কাগজের নাইট রিপোর্টারদের শহরের বিভিন্ন থানায়, ফায়ার ব্রিগেডে, রাইটার্স বিল্ডিংসে রাজ্য পুলিশের কন্ট্রোল রুম এবং লালবাজারে কলকাতা পুলিশের ওসি কন্ট্রোল রুমে বারে বারে ফোন করে ঘটনা-দুর্ঘটনা সম্পর্কে খবর নিতে হয়। একবার ডায়াল করে নিতে হয় আবহাওয়া অফিসেও। অন্যান্য কাগজে ফোন করে সেদিনের নাইট রিপোর্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাও একরকম নিয়মের মতোই। মোটামুটি সবাইই পরস্পরের চেনা। কোনও বড় ঘটনা ঘটলে কারোরই মিস করার কথা নয়।
দিনের বেলায় ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর করে অন্যদের তাক লাগানোর তাগিদ থাকলেও রাতের দিকে কোনও সাধারণ ঘটনা ঘটলে সাধারণত এক কাগজের নাইট রিপোর্টার অন্য কাগজের কাছে চেপে যান না। এটাই রেওয়াজ। অবশ্য কখনও কখন ব্যতিক্রমও ঘটে। তবে তা নেহাত ব্যতিক্রমই। একারণেই এক দফা চেক করে নেওয়ার পর মোটামুটি সবাইই কিছুটা রিল্যাস্কড মুডে কাটায়। মাঝে মাঝে ফায়ার ব্রিগেড আর লালবাজারের নম্বর ঘোরালেই চলে। অন্তত রাত এগারোটার পর থেকে দুটো পর্যন্ত। বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে ওই সময় পর্যন্তই নাইট ডিউটি।
সেদিনও সেরকমই চলছিল।
আমি সবার সঙ্গে একদফা কথা বলে একটু হাল্কা মুডে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। সামনে টেলিফোন। ছ’সাত ফুট দূরে নিউজ ডেস্কে মণীশ মৌলিক নামে একজন সিনিয়র সাব এডিটর কিছু লিখছিলেন। ডেস্কের বাকিরা পেজ মেকিংয়ের ঘরে পরদিনের কাগজের একের পর এক পাতা মেক আপে ব্যস্ত। ওই বাড়িতে পেজ মেকিংয়ের ঘরটা ছিল দোতলার একেবারে অন্যপ্রান্তে। উত্তর দিকের শেষ ঘরটায়। নিউজ রুম থেকে সরাসরি ডাক দিলে পৌঁছবে না। সেজন্য ঘরে ঘরে ইন্টারকম ফোনের ব্যবস্থা। টেলিপ্রিন্টার টেলেক্স কিউবিকলের হাতখানেকের মধ্যেই চেয়ারে বসেছিলাম। মগ্ন ছিলাম ম্যাগাজিনেই।
নিউজরুমে কোনও শব্দ নেই। আচমকাই টেলিপ্রিন্টার থেকে টিং টং করে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ। সাধারণ খবর এলে তো এরকম আওয়াজ হয় না! কেবল কাগজ সরে যাওয়ার ঘ্যাস ঘ্যাস শোনা যায়। তাকিয়ে দেখলাম মণীশদা উঠে এসে টেলিপ্রিন্টার থেকে একটুকরো কাগজ ছিঁড়ে হাতে নিলেন। টেলিপ্রিন্টার বা টেলেক্সে আসা খবরগুলোর ওপর নজর রাখার দায়িত্ব মূলত নিউজ ডেস্কে কর্তব্যরত সাব এডিটরদের। অবাক হয়ে দেখলাম কাগজটা হাতে নিয়ে উনি মিনিট দুয়েক প্রায় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে। মনে হল বিড়বিড় করে কিছু বলছেন।
আমি চেঁচিয়ে বললাম, কী হয়েছে মণীশদা? জবাব নেই। ব্যাপারটা বেশ খটমট লাগল। আমি একলাফে ওঁর পাশে গিয়ে হাত থেকে কাগজের টুকরোটা টেনে নিয়ে চোখ বোলালাম। মাত্র একটাই বাক্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়বার পড়লাম। ‘রাজীব গান্ধী হ্যাজ বিন অ্যাসাসিনেটেড অ্যাট শ্রীপেরামপুদুর, ফর্টি কিলোমিটার অ্যাওয়ে ফ্রম চেন্নাই’। অ্যাঁ। রাজীব গান্ধী নিহত হয়েছেন! রাজীব গান্ধীকে খুন করা হয়েছে!
গলা তুলে বললাম, ও মণীশদা, এ তো মারাত্মক খবর! রাজীব গান্ধী খুন হয়ে গেছেন! আচমকা ওরকম একটা খবর আসবে সেটা সম্ভবত মণীশদা কল্পনাও করতে পারেননি। তাই হঠাৎই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ততক্ষণে, টেলিপ্রিন্টার ফের আওয়াজ তুলেছে। আমরাও ডাকাডাকি শুরু করলাম। পেজ মেকিংয়ের ঘরে ইন্টারকমে খবরটা জানানো হল। ওখান থেকে সবাই ছুটে এলেন।
তারপর প্রথমেই ফোন করলাম বরুণদা’কে। বরুণ সেনগুপ্ত। আমাদের পত্রিকার প্রাণপুরুষ। সম্পাদক। যাঁর কাছে এনি টাইম ইজ নিউজ টাইম। উনি বলেই রাখতেন, কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর এলে যেন ওঁকে জানানো হয়। সে যত রাতই হোক না কেন! সেদিনও অফিসের কাজ সেরে সম্ভবত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাড়ি গেছেন। তখন ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে থাকতেন। টেলিফোনে খবরটা শুনে বললেন, এক্ষুণি আসছি। নিউজ এডিটর তুলসী দত্তের বাড়ি শিয়ালদার কাছে ফরডাইস লেনে। চিফ রিপোর্টার রন্তিদেব সেনগুপ্ত থাকেন উল্টোডাঙার কাছে হাউজিং এস্টেটে। ঘটনার কথা জানিয়ে দু’জনকেই ফোন করে বললাম, রেডি থাকুন, গাড়ি যাচ্ছে।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই বরুণদা চলে এলেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাকিরাও। অফিসে বিপুল কর্মব্যস্ততা। দেখে কে বলবে মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই! শ্রীপেরামপুদুর নামে তামিলনাড়ুর এক অখ্যাত জায়গায় ঘণ্টা কয়েক আগে যে ভয়ঙ্কর ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেছে তার অনেকটাই ততক্ষণে আমাদের কাছে চলে এসেছে নিউজ এজেন্সি মারফত।
জানা গেছে, একটি প্রচারসভায় এক তামিল যুবতী রাজীবের হাতে পুস্পস্তবক তুলে দেওয়ার পর তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণামের ভঙ্গিতে খানিকটা ঝোঁকার সঙ্গে সঙ্গেই কোমরের পিছন দিকে বেল্টের সঙ্গে বেঁধে রাখা শক্তিশালী বিস্ফোরক ফেটেছে। যুবতীর ওই আত্মঘাতী বিস্ফোরণে রাজীবের দেহটি পঁচিশ-তিরিশ খণ্ডে ছিন্নভিন্ন হয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায় ওই যুবতীর দেহও। প্রাথমিকভাবেই জানা গিয়েছিল, ওই ভয়ানক ও নৃশংস কাণ্ডের পিছনে তামিল গেরিলা সংগঠন এলটিটিই যুক্ত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওই খবরগুলোকে যথাসম্ভব গুছিয়ে পরিবেশনের জন্য পুরো নিউজ রুম তুমুল তৎপর।
একের পর এক বিষয়কে ধরে সংবাদ প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে। বরুণদা নিজেও লেখায় হাত লাগালেন। প্রাথমিকভাবে পাওয়া খবর যতটা সম্ভব দিয়ে কাগজ ছাপা শুরু হবে। পরে বার বার প্লেট চেঞ্জ করে নতুন নতুন আপডেট দেওয়া হতে থাকবে। সেসময় নিউজ রুমে কম্পিউটার আসেনি। সাংবাদিকরা কলম দিয়ে লিখতেন। সেই হাতে লেখা কপিগুলো দ্রুত কম্পোজের জন্য পিটিএস (ফটো টাইপ সেটিং) বিভাগে পাঠানো, তারপর ব্রোমাইড নিয়ে পেজ মেক আপের ঘরে প্রথম পাতা তৈরি। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর নতুন নতুন প্রথম পাতা। আগের তুলনায় আরও টাটকা খবর দিয়ে। পরবর্তী ধাপে প্লেট তৈরি। তারপর নীচে প্রেসে। প্রায় সারারাত ধরে ওই চলল।
এরই মাঝে আমি একবার বেরোলাম কলকাতা শহরের অবস্থা দেখতে। বিশেষত দক্ষিণ কলকাতা। কারণ, ইন্দিরা গান্ধীর খুনিরা শিখ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় ওই ঘটনার পর দিল্লিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুব্ধ জনতার হাতে বহু শিখ আক্রান্ত ও নিহত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবরের সেই ঘটনার কথা প্রায় কেউই ভুলে যাননি। সেবার বেশ কয়েকদিন ধরে শিখনিধনপর্ব চলেছিল। মা নিহত হওয়ার পর মাত্র সাতবছর কাটার আগেই ছেলে রাজীবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল।
এদিকে, বহুবছর আগে থেকেই দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু দক্ষিণ ভারতীয়ের বাস। কেউ তামিল, কেউ তেলেগু, কেউবা কন্নড়। কিন্তু কলকাতার বহু সাধারণ বাঙালির কাছে ওরা সবাই-ই ‘মাদ্রাজি’। লেক গার্ডেন্স থেকে শুরু করে দেশপ্রিয় পার্ক, রাসবিহারী মোড়, বালিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। হিন্দুস্থান পার্কে সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব নামে একটি নামকরা ক্লাব ছিল। এখনো রয়েছে। ওখানে বাড়িটির নীচের তলার একাংশে রেস্টুরেন্ট। সেই রেস্টুরেন্টে হরেক রকম দক্ষিণ ভারতীয় খাবার মিলত। দামও বেশ কমই মনে হত। তাই রসনাতৃপ্তির প্রয়োজনে মাঝে মাঝেই হাজির হতাম।
ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই জ্যোতি বসুর বাড়ি। জ্যোতিবাবুর বাবা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক নিশিকান্ত বসু একসময় বাড়িটি বানিয়েছিলেন। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন প্রমুখের বাড়িও আশপাশেই। ওই এলাকায় যাতায়াতের পথে নবনীতা দেবসেনদের বাড়িটার নাম দেখে বেশ মজা পেতাম। নাম ‘ভালো বাসা’। সেসময় আমাদের রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন একজন দক্ষিণ ভারতীয়। এন কৃষ্ণমূর্তি। পুরো নাম নারায়ণন কৃষ্ণমূর্তি।
সেই মুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছিল তামিলনাড়ুর ঘটনার প্রতিঘাত কলকাতায় শুরু হয়ে যাবে না তো! বরুণদা বললেন, একবার ওই এলাকাগুলো ঘুরে এসো। বেরিয়ে পড়লাম। না। এখানে ওখানে টুকটাক জটলা হলেও তেমন মারাত্মক কিছু চোখে পড়ল না। সম্ভবত একটু বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটা তেমন ছড়াতে পারেনি। কেবল হাজরা মোড়ে দেখলাম, কংগ্রেসের কিছু লোকজন সেই গভীর রাতেই পথের মাঝখানে ইট সিমেন্ট প্রভৃতি দিয়ে বেদীমতো কিছু বানানোর চেষ্টা করছেন। মাঝে মাঝে স্লোগান উঠছে, রাজীব গান্ধী অমর রহে।
পরদিন সকালে সমস্ত দৈনিকে খবরটা দেখার পরই প্রায় গোটা কলকাতায় কংগ্রেসের লোকজন দলে দলে পথে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে টায়ার জ্বালানো চলতে থাকে। কিছু গাড়িতেও ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়। তবে, বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও তৎপরতার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টার বাংলা বনধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই বনধ। সেই বনধ ডাকার খবর ভোর হওয়ার আগেই দলীয় সূত্রে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে সকাল থেকেই পথেঘাটে বাস ট্রাম নামেনি। অন্যান্য যানবাহনও নেমেছিল হাতে গোণা। প্রধানত এ কারণেই সেদিন মহানগরীতে বড় গোলমাল এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
মনে পড়ছে, ওই ঘটনার বছর চারেক আগে রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের ছাড়পত্র ইস্যুকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রবল বাক বিতণ্ডা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু প্রায়ই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন। তাঁর একদিনের একটি বিশেষ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মন্তব্য করলেন, বাসুজির বয়স তো অনেকই হল। এবার উনি রিটায়ার করুন না!
পরদিনই রাইটার্স বিল্ডিংসে সাংবাদিকরা ওই প্রসঙ্গ তুললে জ্যোতিবাবুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, আমি রিটায়ার করব কেন? বরং ওনাকেই রিটায়ার করিয়ে ছাড়ব। জ্যোতিবাবুর কথা ফলে গিয়েছিল। ৮৭-র লোকসভা ভোটেই বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের নেতৃত্বে বিরোধীরা একজোট হয়ে রাজীবের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়েছিল। কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক নির্বাচনী প্রচার সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের একটি হাত ধরেছিলেন জ্যোতি বসু, অন্য হাতটি বিজেপি’র অটল বিহারী বাজপেয়ি।
বাম, বিজেপি, জনতা একজোট হয়েছিল। সেবারের ভোটে রাজীবের কংগ্রেস পরাজিত হয়। তবে তিনি রাজনীতি থেকে রিটায়ার করেননি। দেশবাসীর সমর্থন ফিরে পেতে সক্রিয়ই ছিলেন। এগিয়েও ছিলেন অনেকটাই। কিন্তু ১৯৯১ এর ২১ মে তামিল সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এলটিটিই’র একটি বোমা বিস্ফোরণ রাজীব গান্ধীকে জীবন থেকেই রিটায়ার করিয়ে দিল।