হোমআন্তর্জাতিকCRIME REPORTER : একইসঙ্গে ভারত-আমেরিকার চরবৃত্তির এক অনন্য কাহিনী

CRIME REPORTER : একইসঙ্গে ভারত-আমেরিকার চরবৃত্তির এক অনন্য কাহিনী

CRIME REPORTER : একইসঙ্গে ভারত-আমেরিকার চরবৃত্তির এক অনন্য কাহিনী

(CRIME REPORTER : এই পর্বে শোনানো হবে নানান অপরাধ কাহিনী। বিভিন্ন রহস্যজনক ঘটনার নেপথ্য কাহিনী। বিখ্যাত গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর তদন্তের রোমহর্ষক গল্প। নানা দেশের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর গোপনে খবর সংগ্রহের গল্প আড্ডার মত করে উঠে আসবে বিশিষ্ট সাংবাদিক হীরক কর -এর কলমে।)

হীরক কর : আপনাদের মনে আছে এই ক্রাইম রিপোর্টার কলমে বেশ কিছুদিন আগে এক ভারতীয় গুপ্তচরের গল্প বলেছিলাম, যার নাম ছিল রবীন্দ্র কৌশিক। ‌ যিনি ছিলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিস উইং’ বা “র”-এর এজেন্ট। যিনি পাকিস্তানে গিয়ে সেদেশের আর্মির মেজর পর্যন্ত হয়েছিলেন।‌ নিজের প্রাণ বাজি রেখে ভারতের জন্য বিভিন্ন গোপন তথ্য এদেশে পাঠিয়েছিলেন। পাকিস্তানে বিয়ে করা স্ত্রীও এই গুপ্তচরবৃত্তির কথা জানতে পারেননি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তারিফ করে তার নাম রেখেছিলেন “ব্ল্যাক টাইগার”।

এই “র”-এর আরেকটি কাহিনী এখন আপনারা পড়তে যাচ্ছেন।‌ এই কাহিনী “র”-এর  কালো অধ্যায় বলতে পারেন। ‌ একদিকে রবীন্দ্র কৌশিক, অন্যদিকে এই এজেন্ট, যিনি ছিলেন ডাবল এজেন্ট। ‌ অর্থাৎ, তিনি যেমন “র”-এর এজেন্ট ছিলেন, তেমনই আমেরিকান গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র হয়েও কাজ করতেন। সবটাই করতেন পয়সার জন্য। এক কথায় একে বলা যায় গদ্দার। কেননা দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে আমেরিকার সিক্রেট এজেন্সির হয়ে কাজ করেছেন। এর নাম রবীন্দ্র সিং। কিছু না হলেও নামের মিল আছে। রবীন্দ্র কৌশিক দেশের জন্য একজন বাফাদার, লয়াল  মানুষ। আর রবীন্দ্র  সিংকে গদ্দার বললে ভুল বলা হবে না।

রবীন্দ্র সিং শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। সেনাবাহিনী মেজর পর্যন্ত হয়ে ছিলেন। যিনি ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডেপুটেশনে RAW-তে যোগ দিয়েছিলেন। অবসর গ্রহণের পর “র” এর সঙ্গে যুক্ত হন। সময়টা আশির দশক। “র”-এর বিভিন্ন পদে কাজ করেন। শেষে র-এর যুগ্ম সচিব হন।

২০০৪-এর এপ্রিল মাস। ‌ দিল্লিতে র-এর সদর দফতরে একদিন হঠাৎ করে হৈচৈ শুরু হয়। ওই দিন সন্ধেয় “র” এর দফতর ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত কর্মী বাড়িতে  যাবার জন্য তোড়জোড় করছিলেন। এক এক করে বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন তাঁরা। ওই  দিন বাইরে বেরনোর গেটে প্রচুর ভিড় ছিল। ‌ কেননা প্রস্থান পথে বেশকিছু নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন যারা “র”-এর কর্মীদের তল্লাশি করছিলেন। ‌ ফলে, প্রত্যেকেরই গাড়ি, বাস বা মেট্রো স্টেশন অবধি পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। “র”-এর দফতর  থেকে যাঁরাই বের হচ্ছিলেন, তাঁদের তল্লাশি করা হচ্ছিল। “র”-এর ইতিহাসে এই ঘটনা ছিল এই প্রথম। ‌

“র”-এর সদর দফতর যেখানে “র”-এর চিফ,‌ সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ডেক্সের কর্মীরা, ফিল্ড স্টাফ, সবাই বসেন, সেই তাঁদের তল্লাশি নেওয়া হচ্ছিল। কোনও সিনিয়র জুনিয়র ভেদের ব্যাপার ছিল না। ছোট বড় সকলের তল্লাশি নেওয়া হচ্ছিল। সবারই ব্যাগ খুব ভালো করে দেখা হচ্ছিল। আশেপাশের অফিসের কর্মীরা চমকে উঠেছিলেন। “র”-এর কর্মীদের কেন তল্লাশি নেওয়া হচ্ছে ?

ওই দিন দফতরে রবীন্দ্র সিং বসেছিলেন। বাড়ি যাবার আগে তিনি ড্রাইভারকে ফোন করেন, গাড়ি নিয়ে অফিসের  সদর দরজায় আসতে বলেন। ড্রাইভার জানান, বাইরে গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। কেননা সমস্ত কর্মীদের তল্লাশি করা হচ্ছে। রবীন্দ্র সিং চমকে যান।‌ এটা কি হচ্ছে? ডাইভারের  কাছ থেকে রবীন্দ্র সিং জানতে পারেন, সকলকেই তল্লাশি করা হচ্ছে। ‌ রবীন্দ্র সিং গেটে পৌঁছন। অন্যদের মতো তাকেও তল্লাশি করা হয়। তার ব্রিফকেস খুলে দেখা হয়। কিন্তু ওই ব্রিফকেসে এমন কিছু মেলে না, যাতে রবীন্দ্র সিংকে সন্দেহের তালিকাভুক্ত করা যায়।

এক সপ্তাহ পরে “র”-এর উচ্চপদস্থ কর্তাদের একটি বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে “র”-এর তৎকালীন চিফ সি ডি সহায় উপস্থিত ছিলেন। ‌ সেখানে এই তল্লাশির বিষয়টি ওঠে। তল্লাশির জন্য ক্ষুব্ধ রবীন্দ্র সিং বলেন, সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে, তা হওয়া উচিত নয়। ওই তল্লাশির প্রতিবাদ করে রবীন্দ্র সিং বৈঠক শেষে বেরিয়ে যান। পরে জানা যায়, এপ্রিল ২০০৪-এ “র”-এর সদর দফতরে যে তল্লাশি চালানো হয়েছিল, তা শুধুমাত্র একজনের জন্যই। তিনি হলেন এই  রবীন্দ্র সিং।

কিন্তু ওর ব্রিফকেস থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, উনি যখন ড্রাইভারকে বলেন গাড়ি নিয়ে এসো, ড্রাইভার বলে, স্যার এখানে ভিড় আছে। তল্লাশি চলছে। তল্লাশির কথা  রবীন্দ্র সিং জেনে যান। তাই তিনি ব্রিফকেসে কোনরকম ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে  আসেননি। তাই তাঁর কাছ থেকে ওই দিন কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। ‌ প্রশ্ন হল, কেন ভারত সরকার রবীন্দ্র সিংয়ের তল্লাশি নিতে চাইছিল ?

“র”-এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে একটা গুঞ্জন চলছিল, এখানে এমন কেউ আছেন যিনি অন্য রাষ্ট্রে খবর লিক করেন। গোপন তদন্ত হলে কোনও না কোনওভাবে রবীন্দ্র সিংয়ের নাম উঠে আসে। “র”-এর একটা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট রয়েছে। ‌ যার নাম, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (সিআইএস), তাদেরকেই রবীন্দ্র সিংয়ের পিছনে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি কোথায় যান, কি করেন, দেখার জন্য। তার জন্য তার গাড়িতে বিশেষ ডিভাইস লাগানো হয়েছিল। ‌ যাতে রবীন্দ্র সিং এবং তাঁর ড্রাইভার গাড়িতে বসলেও, তাঁরা কী কথাবার্তা বলেন, সবটাই শুনতে পান “র”-এর সদর দফতরে বসে সিআইএস-এর গোয়েন্দারা। ‌তাঁর বাড়িতেও এই ধরনের ইকুপমেন্ট, ক্যামেরা লাগানো ছিল। ‌ পুরো বাড়িটাই ছিল সার্ভিলেন্সে। বাড়ির বাইরে যাঁরা তাঁকে সবজি ইত্যাদি দিয়ে যেতেন, তাঁরাও ছিলেন “র”-এর লোক। যিনি প্রতিদিন নিউজপেপার দিতেন তিনিও গুপ্তচর। সাফ সাফাই করার জন্য যে ঝাড়ুদার আসতেন, তিনিও গুপ্তচর। যে ডাক পিওন আসছেন, তিনিও গুপ্তচর। ‌ এরা প্রত্যেকেই সিআইএস-এর লোক। তিনি  ছিলেন  র-এর পুরো নজরবন্দি। অজান্তে তাঁর ওপর নজর রাখা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, তিনি কোনও বিদেশির সঙ্গে মেলামেশা করেন কিনা, সেটা দেখা। ‌ কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। কোন বিদেশির সঙ্গে রবীন্দ্র সিং দেখাই করেন নি। এতে ‌”র”-এর উচ্চপদস্থ কর্তাদের ধাক্কা লাগে। ‌ কিন্তু তদন্ত জারি ছিল।

“র”-এর সদর দফতরে প্রায়ই দেখা যেত, রবীন্দ্র সিং জেরক্স মেশিনে ফটোকপি করছেন। এমন অনেক ফটোকপি করেছেন, যার সঙ্গে তার ডিপার্টমেন্টের কোনও লেনদেন ছিল না। তাতে সন্দেহ হয়। ‌ সিআইএস ওই জেরক্স মেশিনে এ রকমই একটি ইকুপমেন্ট বসায়। কেউ যদি ওই জেরক্স মেশিনে ফটোকপি করে ,সঙ্গে সঙ্গে তার কপি মেশিনে স্টোর হয়ে যাবে।‌ এরপর থেকে সন্ধেবেলা রবীন্দ্র সিং বাড়ি চলে গেলে মাস্টার কি দিয়ে ওই ফটোকপি মেশিন খোলা হত। দেখা হতো সারাদিন ধরে রবীন্দ্র সিং কি কি জেরক্স করেছেন।

দেখা যায়, “র”-এর এমন কিছু গোপন ডকুমেন্ট ফটোকপি করেছেন তার সঙ্গে রবীন্দ্র সিংয়ের কাজ, ইনভেস্টিগেশন বা ডিপার্টমেন্টের কোন সংযোগ নেই। তখনই সন্দেহটা তৈরি হয়। বাড়িতে যে সার্ভিলেন্স ক্যামেরা বসানো হয়েছিল, তার থেকে কিছু মেলে না।

কিন্তু একদিন রবীন্দ্র সিং যখন বাড়িতে ছিলেন না, তখন গোপন তল্লাশি করে জানা যায়, তিনি “র”-এর ডকুমেন্ট জেরক্স করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। ওয়েব ক্যামের মাধ্যমে কারও সঙ্গে কথা বলতেন। এফটিপি দিয়ে সমস্ত ডকুমেন্ট পাচার করতেন। এটা জানার পরই “র”-এর কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারেন রবীন্দ্র সিং ডাবল এজেন্ট। তিনি যে সব ডকুমেন্ট পাচার করছিলেন, সেগুলো সবই যাচ্ছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-এর কাছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য ছিল। সন্দেহ শুরু হয় ইরাক সম্পর্কিত  বিষয় নিয়ে। ‌ কেননা ইরাকের ব্যাপারে তাঁর কাজ করার কথাই নয়।

রবীন্দ্র সিংয়ের বিরুদ্ধে পাক্কা প্রমাণ মেলার পর “র” -এর তৎকালীন চিফ সহায় সাহেব তখনকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রের‌ সঙ্গে কথা বলেন।  বলেন, রবীন্দ্র সিং ডাবল এজেন্ট। সিআইএ-এর হয়ে কাজ করে। ‌ তাঁকে গ্রেফতার করার অনুমতি দেওয়া হোক। কিন্তু ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে। ‌ কেননা, ওই বছর মে মাসে নির্বাচন ছিল। আশঙ্কা ছিল “র”-এর ডাবল এজেন্টের  খবর বাইরে বেরিয়ে পড়লে নির্বাচনী ইস্যু হতে পারে। তাই বিষয়টিকে নির্বাচন পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়।

এরই মধ্যে মে মাসে, রবীন্দ্র সিংয়ের সন্দেহ হয়, তার পিছনে নজরদারি চলছে। তিনি একবার “র” -এর এক পদস্থ কর্তাকে বলেছিলেন, আমার বাড়িটা পরিষ্কার করা দরকার। আমার ধারণা কিছু ইকুপমেন্ট দিয়ে বাড়িটাকে সার্ভিলেন্সে রাখা হয়েছে। ‌ ফলে র-এর পদস্থ কর্তারাও বুঝতে পারেন তাঁর পিছনে  নজরদারি করা হচ্ছে বলে রবীন্দ্র সিং নিজেই সন্দেহ করছে।

ঠিক দু সপ্তাহ আগে, ২০০৪-এর এপ্রিলের শেষে, রবীন্দ্র সিংয়ের বাড়িতে নজরদারি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কেননা ইতিমধ্যেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে তাকে গ্রেফতারের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল ।‌ অনুমতি মেলেনি। কিন্তু যে কোনো সময় অনুমতি পাওয়া যাবে বলে তিনি যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন, তাই নজরদারি আরো বাড়ানো হয়।

৬ মে,২০০৪। রাতে দিল্লির ডিফেন্স কলোনির ওই বাড়িতে এইরকম নজরদারি চলছিল। সন্ধেবেলা রবীন্দ্র সিংয়ের স্ত্রী পারমিন্দর সিং তাঁর এক আত্মীয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হন। আরেক আত্মীয়র বাড়ি যান। কিন্তু রবীন্দ্র সিং ঘরেই ছিলেন। ‌রাত হবার আগেই তাঁর স্ত্রী বাড়ি ফিরে আসেন। এরপরে বাড়ি থেকে কেউ বাইরে  আসেনি। বাইরে থেকে কেউ বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি।‌ একসময় রাত শেষ হয়ে ভোর হয়।

কিন্তু সকাল হতেই আজবকান্ড সবার নজরে আসে। বাড়ির মধ্যে থেকে কোনওরকম আওয়াজ আসছিল না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কথাবার্তা হচ্ছিল না। অন্যদিনের মত তারা দুজনে প্রাতঃভ্রমণে বেরোননি। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছিল। এতে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা “র”-এর গুপ্তচরের সন্দেহ হয়। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক সদস্যকে ডাক পিয়ন বানিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। বেল বাজিয়ে দেখতে বলা হয় ঘরের মধ্যে কি হচ্ছে? বেল বাজলে পরিচারক বেরিয়ে আসেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় সাহেব কোথায়? উত্তর আসে, সাহেব মেমসাহেব দুজনেই পাঞ্জাবে এক আত্মীয়ের বিয়েতে চলে গেছেন।

এতেই রবীন্দ্র সিংয়ের বাড়ির বাইরে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকা “র”-এর গুপ্তচরদের মাথা ঘুরে যায়। ‌ তাঁরা সারারাত নজরদারি রাখছিলেন বাড়ির বাইরে কেউ বেরোয়নি। ‌ বাড়ির ভেতরে কেউ ঢোকেনি। ‌ অথচ সাহেব মেমসাহেব গায়েব! এখন পরিচারক বলছে,পাঞ্জাবে চলে গেছে। “র”-এর উচ্চপদস্থ অফিসারদের খবরটা জানানো হয়।

আসলে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে মধ্য রাতের অন্ধকারে রবীন্দ্র সিং তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে যান। দুজনে একজন আত্মীয়র সঙ্গে উত্তরপ্রদেশে হয়ে নেপাল সীমান্তে পৌঁছন।‌ সেখানে আগে থেকে বুক করা একটা হোটেলে থাকেন। ‌ কাঠমান্ডুর বাইরে ছিল এই স্নেহা হোটেল। ‌ দিল্লি থেকে নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে কাঠমান্ডু ঢোকার আগে এই স্নেহা হোটেলেই তাঁরা রাত কাটান। পরের দিন নেপালের আমেরিকান দূতাবাসে সিআইএ এজেন্ট ডেভিড বসালার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কেননা এই ডেভিডই রবীন্দ্র সিংয়ের হ্যান্ডেলার ছিলেন। পরদিন আমেরিকান দূতাবাসের মদতে ডেভিড রবীন্দ্র সিং এবং তাঁর স্ত্রীর জন্য নতুন পাসপোর্ট তৈরি করেন। নতুন পাসপোর্টে রবীন্দ্র সিংয়ের নাম হয় রাজপাল প্রসাদ  শর্মা। ‌ তাঁর স্ত্রীর নাম হয় দীপা শর্মা। তাঁদের আমেরিকান পাসপোর্ট হয়। পাসপোর্ট তৈরি করার পর তাদের আমেরিকান ভিসা দেওয়া হয়। ৭ মে অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তাঁরা কাঠমান্ডু থেকে উড়ে যান। এবং  আমেরিকায় পৌঁছে যান। দিল্লি থেকে বের হন, নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে কাঠমান্ডু পৌঁছন, আর আমেরিকার নাগরিক সেজে আমেরিকায় পৌঁছে যান।

“র”-এর দফতরে হইচই পড়ে যায়। কেননা, “র” -এর জয়েন্ট  সেক্রেটারি সিআইএ-র হয়ে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। ‌পোক্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সবুজ সংকেত দিতে গড়িমসি করেন । ফলে গ্রেফতার করা যায়নি। কিন্তু এই ডাবল এজেন্ট দিল্লি থেকে উধাও হয়ে আমেরিকায় গিয়ে উদয় হন। অদ্ভূত ঘটনা।

যেখানে “র”-এর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট খবরের কাগজওয়ালা, সবজিওয়ালা, বাগানের মালি, ডাক পিয়ন, সেজে রবীন্দ্র সিংয়ের বাড়িতে নজরদারি চালাচ্ছিল। ‌ সেখানে তাদের নাকের ডগা দিয়ে রবীন্দ্র সিং পালিয়ে গেলেন, এটা নিয়ে
“র”-এর অন্দরমহলে চরম চাপান-উতোর চলে।  “র”-এর চিফ সহায় ভারতের আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের সাহায্যেই কি রবীন্দ্র সিং আমেরিকায় পালিয়ে গেছে? যথারীতি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত তা অস্বীকার করেন।

ভারত সরকার বিষয়টি জানতে পেরে কোন গুরুত্ব দেয় না। ‌২০০৪-এর ৭ মে রবীন্দ্র সিং পালিয়ে গিয়েছিলেন। ‌ আর ১৪ মে নির্বাচন ছিল। তাই আস্তে আস্তে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে চলে যায় ইতিমধ্যেই ।

রবীন্দ্র সিং আমেরিকায় পৌঁছতেই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। ‌ কিন্তু ২০০৪ শেষ হতে না হতেই আমেরিকা হাত ঝেড়ে ফেলে । রবীন্দ্র সিংয়ের কন্যাও আমেরিকায় থেকেই লেখাপড়া করছিল।‌ “র”-তে থাকার সময়ই রবীন্দ্র সিং “র”-এর চিফের কাছে আমেরিকায় যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন। ‌বলেছিলেন, তাঁর কন্যার পাত্র দেখা হচ্ছে। তাই তিনি আমেরিকায় যেতে চান। ‌ কিন্তু কিছু সন্দেহ থাকায় “র”-এর চিফ অনুমতি দেননি।  অবশ্য ২০০৪-এ ভারত থেকে পালিয়ে তিনি আমেরিকায় পৌঁছন। এতদিন ঠিকই ছিল। কিন্তু ২০০৪-এর শেষে সিআইএ তাঁর হাত ছেড়ে দেয়। তাঁকে যে নিয়মিত টাকা দেওয়া হতো, সেটা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‌ তাঁকে যে আশ্রয়  দেওয়া হয়েছিল সেটাও কেড়ে নেওয়া হয়। ছোটখাটো কাজ করে রবীন্দ্র সিং জীবনযাপন করতে থাকেন। এর পরে তার আর কোনও খবর মেলে না।

খবর পাওয়া যায় ২০১৬ সালে। রবীন্দ্র সিং আমেরিকার মেরিল্যান্ড এলাকায় একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। খবর “র”-এর কাছে এসে পৌঁছয়। ২০০৪ থেকে ২০১৬ রবীন্দ্র সিং আমেরিকাতেই ছিলেন। নিউ ইয়র্ক, মেরিল্যান্ড এবং পার্শ্ববর্তী ভার্জিনিয়ায় কাটিয়েছেন। যেখানে তার পরিবার এখনও  রয়েছে।

কিন্তু তিনি আর কোনো কাজের নন বলে সিআইএ যখন তাঁর হাত ছেড়ে দিয়েছিল, তখন তিনি আর্থিক অনটনে ভুগছিলেন। সিআইএ-এর এক এজেন্টের একটি কোম্পানি চলছিল। সেখানে তিনি কাজ করতে চাইলে সিআইএ-এর চাপে তাঁকে কাজ দেওয়া হয়নি। আদৌ কি পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। নাকি সিআইএ তাঁকে খুন করিয়েছে। এ নিয়ে “র”-এর অন্দরেই সন্দেহ রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে রবীন্দ্র সিংকে সিআইএ তাদের জালে ফাঁসালো কেন ? এর জন্য ফিরে যেতে হবে হবে ১৯৭১-এ। যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ গঠনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী। ‌ আর আমেরিকায় নিক্সন সরকার। ১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁর ক্যাবিনেটে এমন একজন মন্ত্রী ছিলেন যাকে বলা হত সিআইএ এজেন্ট। সেই সময় এই নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ১৯৮৯-এ ওয়াশিংটন পোস্ট খবর ছেপেছিল, কে সেই মন্ত্রী যে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেটে সিআইএ এজেন্ট। কে সেটা কখনই জানা যায়নি। তখন থেকেই ভারতীয় প্রশাসনের অন্দরমহলের সিআইএ ঢুকবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু সক্ষম হয়নি।

সময় চলে গেছে। এর পরবর্তী সময় ১৯৯৮-এ রাজস্থানের পোখরানে ভারত পরমাণু বিস্ফোরণ করে। এই পরমাণু পরীক্ষা ছিল সিআইএ -এর কাছে বড় ব্যর্থতা। ভারত পরমাণু পরীক্ষা করছে সিআইএ ঘূণাক্ষরেও তা জানতে পারেনি। আমেরিকা জানতে পারলে হয়তো এই পরীক্ষা হতে পারত না। আন্তর্জাতিক স্তরে তারা প্রচুর বাধা সৃষ্টি করত। আর্থিকভাবে ভারতের ওপর চাপ তৈরি করত।

এরপরে সিআইএ ভারতে তাদের এজেন্ট তৈরি করার জন্য খোঁজ শুরু করে। সেই খোঁজ শেষ হয় “র”-এর জয়েন্ট সেক্রেটারি রবীন্দ্র সিং-এর কাছে গিয়ে। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-র ফাঁদে পড়েন রবীন্দ্র সিং। যখন হল্যান্ডে পোষ্টেড ছিলেন তখন ‘হানি ট্রাপ’- এর মাধ্যমে সিআইএ তাঁকে ফাঁসায়। সিআইএ-এর এক মহিলা গুপ্তচর রবীন্দ্র সিংকে তার জালে ফাঁসায় । ধীরে ধীরে এমন ফাঁসায় যে রবীন্দ্র সিং ওই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। সিআইএ যা বলেছে, উনি তাই করে গেছেন। উনি জুনিয়র সকলের কাছ থেকে বিভিন্ন ইনফরমেশন নিতেন। তাদের খুশি করার জন্য বড় বড় হোটেলে বাড়িতে ককটেল পার্টি দিতেন। ওই ইনফর্মেশন সিআইএকে পৌঁছে দিতেন। ‌

রবীন্দ্র সিংকে ব্যবহার করা হয় মূলত ইরাকের যুদ্ধের জন্য। কেননা সেই সময় গুঞ্জন ছিল ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। যা  সাদ্দাম হোসেন বারবার অস্বীকার করে গিয়েছিলেন।‌ আমেরিকানদের ধারণা ছিল, ভারতের সঙ্গে যেহেতু ইরাকের সম্পর্ক ভালো, তাই সেই তথ্য জানে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা। আর একবার ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্রের সন্ধান পেলে সারা পৃথিবীকে বোঝানো যাবে আমেরিকানরা বিনা কারণে ইরাক আক্রমণ করেনি। তাই রবীন্দ্র সিংকে লাগাতার ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও আমেরিকা এখনো প্রমাণ করতে পারেনি যে, সেই সময়ে ইরাকের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র ছিল। ‌যার ওপর ভিত্তি করে তারা ইরাক আক্রমণ করেছিল। সাদ্দাম হোসেনকে গদিচ্যুত করেছিল।

রবীন্দ্র সিংয়ের এই অপকর্মের জন্য ভারত কখনো তাকে মাফ করে নি। ১২ বছর আমেরিকাতে কাটিয়ে তিনি কখনো অনুতপ্ত বোধ করেননি। কখনো বলেননি তিনি দোষ স্বীকার করে ভারত সরকারের কাছে সারেন্ডার করবেন।২০০৪ সালে যখন তিনি ভারত থেকে পালিয়ে যান, প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া তাঁকে বরখাস্ত করেন। ৫ জুন ২০০৪ -এ তাঁকে সার্ভিস থেকে বরখাস্ত করা হয়।

spot_img
spot_img

সবাই যা পড়ছেন

spot_img