শুভদীপ রায় চৌধুরী
এক সময় ২৪ অগাস্ট এলেই বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে কলকাতার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই তিলোত্তমার জন্মদিন উদযাপনের এক চেনা ছবি ধরা পড়ত। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, ততই যেন সেই চেনা ছবির কোন অংশই চোখে পড়ছে না, কারণ কোনও মিথ বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। কলকাতার মতন এতবড় মহানগরীর প্রতিষ্ঠাতা কেউ একজন হতে পারে কি? ঠিক এই প্রশ্নটাই আদালতে তুলেছিলেন সাবর্ণ রায় চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কলকাতার ৯ জন বুদ্ধিজীবী। জব চার্নক ১৬৯০ সালের ২৪ অগাস্টে সুতানুটি এলেন, আর সেই দিনই কলকাতার জন্ম হল! এ প্রশ্ন কোর্টেও তোলা হয়। তবে এই ভ্রান্ত ইতিহাসকে মেনে নেননি বিচারপতিরা, তাই তাঁদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কলকাতার কোনও জনক নেই।
আমরা জব চার্নকের যে ছবিটি সচরাচর দেখতে পাই, ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে সেটি নাকি চার্নকের ছবিই নয়! এমনকি চার্নক তৃতীয়বার যখন সুতানুটিতে আসেন তখন তিনি এক গুপ্তরোগে আক্রান্ত ছিলেন। গোবিন্দুপুর কিংবা কলিকাতা তো দূর, বাড়ির বাইরে অবধি বেরোতেনই না! তাহলে তিনি কিভাবে কলকাতার জনক হন? যদিও চার্নককে জনক তৈরির পেছনে ছিলেন কয়েকজন পেড হিস্টোরিয়ান, যারা বরাবরই বিদেশী সভ্যতাকে দেশীয় ভাবধারায় প্রবেশ করাতে একেবারে বধ্যপরিকর ছিলেন। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনও চাপা থাকে না, কলকাতার আদি ইতিহাস সেই প্রকাশিত হয়েই গেল। কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামালার রায়ে (১৬ মে ২০০৩ সাল), বিচারপতি অশোক কুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেন যে, জব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন এবং কলকাতার
কোনও জন্মদিন নেই।
সাহিত্যগত, প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা মৌখিক ইতিহাসের উপাদানের ভিত্তিতে বলা যায় যে, তিলোত্তমা দুই হাজার বছরেরও প্রাচীন। ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসা বিজয় কাব্যে ‘কলিকাতা’র উল্লেখ রয়েছে। ‘পূর্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা/বেতোড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।’ যদিও অনেকেই বিপ্রদাসের এই ‘কলিকাতা’ শব্দটিকে পরে সংযোজিত বলেছেন। তবে ঐতিহাসিক রাধারমণের যুক্তি যে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুকেই প্রক্ষিপ্ত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও কলকাতার নাম উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থে উল্লেখ আছে– ‘কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা/বেতোরেতে উত্তরিল অবসান বেলা।’ এছাড়া, কলকাতায় কালীক্ষেত্রের অবস্থান বহুদিনের। বহু সাধক, এমনকি রাজা-জমিদাররা এই পীঠে পুজো দিতে আসতেন, এসেছেন গুরুনানকও।
এর পাশাপাশি, ১৬৭৬-৭৭ সালে কৃষ্ণরাম দাস রচিত কালিকামঙ্গল কাব্যে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কলকাতার – ‘অতি পুণ্যময় ধাম/সরকার সপ্তগ্রাম/কলিকাতা পরগণা তায়।’ তাছাড়া বহু ঐতিহাসিক এই যুক্তি দিয়েছেন যে, জোব চার্নক আসার বহু আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। তাই চার্নক এলেন আর কলকাতার প্রতিষ্ঠা হল, এমন ভাবনা নিছকই ছেলেমানুষি ছাড়া কিছুই নয়। ঐতিহাসিক রাধারমণ মিত্র দেখিয়েছেন যে, ইংরাজদের নথিপত্রেও ‘ক্যালকাটা’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৮ সালের ২২ জুন চার্লস আয়ার ও রজার ব্র্যাডিলের লেখা এক চিঠিতে। তাই ১৬৯০-এর ২৪ অগাস্টকে কখনও শহরের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। সর্বোপরি, কোনও শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলে একজনকে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। এই কলকাতা তৈরি হয়েছে বাঙালির কৃষ্টিতে, বাঙালির কল্পনায়, কোন বিদেশীর জাদুদণ্ডে নয়।
১৬০৮ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল অবধি এই শহরের জমিদারী সামলেছেন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের সুসন্তানরা। সেই সময়ে সুতালুটায় (বর্তমানে সুতানুটি) সুতোর ব্যবসা খুবই জনপ্রিয়। তিনটি ইউরোপীয় ব্যবসায়ী সংগঠন (ডাচ, ওলন্দাজ ও ফরাসি) সুতানুটিতে রমরমিয়ে সুতোর ব্যবসা করছে। এমনকি ১৬১০ সাল থেকে কলকাতায় সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গিয়েছে, তৈরি হচ্ছে পাকা রাস্তা, দ্বিতল পাকা বাড়ি। সাবর্ণ চৌধুরীদের প্রথম জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী তৈরি করেছিলেন প্রথম পাকা রাস্তা, যেটি পিলগ্রিম্সরোড (উত্তরে হালিশহর থেকে কালঘাট হয়ে বড়িশা) নামেই পরিচিত। তাছাড়া জব চার্নক এর আগেও দু’দুবার সুতানুটিতে এসেছিলেন। আর শেষবার নবাবের তাড়া খেয়েই সুতানুটিতে আশ্রয় নিতে আসেন। কারণ চার্নক জানতেন যে, নবাব সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারির মধ্যে প্রবেশ করবেন না, তাই সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিলেন চার্নক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই তৃতীয়বারের সুতানুটি আগমন স্থায়ী হলেও, তা কখনই একটা শহরের পত্তন নয়। তাছাড়া চার্নক যেখানে আস্তানা গড়েন, সেটা ছিল সুতানুটি, কলকাতা নয়। এছাড়া, এখানে আসার কিছুকাল পরেই, (১৬৯৩-এর ১০ জানুয়ারি) চার্নকের মৃত্যু হয় সুতানুটিতেই। তাই জোব চার্নককে কখনই তিলোত্তমার জনক বলে উল্লেখ করা যায় না।
এই কলকাতার জন্মদিনের পাশাপাশি পেইড হিস্টোরিয়ানের একাংশ আরও একটি মিথ তৈরি করেন, সেটি হল মাত্র ১৩০০টাকায় কলিকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতানুটি সাবর্ণ চৌধুরীরা বিক্রি করে দিয়েছিল চার্নকের কাছে! এমনই সব ইতিহাসের ভ্রান্ত তথ্য তুলে ধরে ইতিহাসপ্রেমীদের বিভ্রান্ত করেছিলেন কিছু পেড হিস্টোরিয়ান। বলা বাহুল্য, কলকাতা কখনই বিক্রি করা হয়নি, কারণ কলকাতা বিক্রি করার অধিকার সাবর্ণ চৌধুরীদের ছিল না, তাঁরা কেবলমাত্র লিজ বা স্বত্ব দেওয়ার অধিকারী। তাই বড়িশার আট চালায় জব চার্নকের জামাতা চার্লস আয়ারের সঙ্গে সাবর্ণ চৌধুরীদের তিনটি গ্রামের স্বত্ব হস্তান্তরিত হয় বার্ষিক ১৩০০ টাকা খাজনার বিনিময়ে।
কলকাতার জায়গীরদার পরিবার সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা ২০০১ সালে দায়ের করা একটি মামলার (WP No. 1484 of 2001) সুবাদে কলকাতা হাইকোর্ট তৎকালীন প্রধান-বিচারপতি অশোককুমার মাথুর ও বিচারপতি জয়ন্ত কুমার বিশ্বাসের ডিভিশন বেঞ্চ ইতিহাসবিদ নিমাইসাধন বসু, বরুণ দে, প্রদীপ সিনহা, অরুণ দাশগুপ্ত এবং সুশীল চৌধুরীকে নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে দেন। মূলত, কলকাতা শহরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে, তা খুঁজে বের করবার জন্যই ওই কমিটি তৈরি হয়। আর কমিটির পেশ করা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ২০০৩-এর ১৬ মে বিচারপতিরা রায় দেন যে, “কলকাতার কোনও নির্দিষ্ট জন্মদিন নেই, আর কলকাতার কোনও প্রতিষ্ঠাতাও নেই।”