হীরক কর : অরণ্য-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য রুখতে বদ্ধপরিকর নতুন বনমন্ত্রী জ্যেতিপ্রিয় মল্লিক (Jyotipriya Mallick)। রাজনৈতিক রঙ যাই হোক না কেন, কাঠ-মাফিয়া, চোরাশিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য ইতিমধ্যেই সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বনমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, চোরাই কাঠ নিয়ে ধরা পড়লে আর আইপিসি নয়, ১৯৫৭ সালের অরণ্য আইনে জামিন অযোগ্য অপরাধে গ্রেফতার করা হবে। সেক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩ বছরের হাজতবাস নিশ্চিত। হরিণ, গন্ডার বা বাঘ মারলে ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণ আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে।
বন দফতরের দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্যোতিপ্রিয়বাবু বুঝতে পেরেছেন, মাফিয়ারা যেভাবে বনসম্পদ ধ্বংস করে চলেছে, তাতে আগামী দিনে রাজ্যবাসীকে তার ভয়ঙ্কর মাশুল দিতে হবে। তাই শুরু থেকেই এই মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নেমেছেন তিনি। কাজটা যে কঠিন, তা বুঝতে পারছেন মন্ত্রী। তবে আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চল রাজ্যের মোট ভৌগোলিক আয়তনের মাত্র ১৪ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের (২৩ শতাংশ) তুলনায় বেশ কম। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সুন্দরবনের একাংশ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণভাগে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের মোট বনভূমির পরিমাণ ১১,৮৭৯ বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৭,০৫৪ বর্গ কিলোমিটার রিজার্ভ ফরেস্ট, ৩৭৭২ বর্গ কিলোমিটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং ১,০৫৩ বর্গ কিলোমিটার অঘোষিত বনভূমির অন্তর্গত। এই বনভূমি রাজ্যের মোট ১৩.৩৮ শতাংশ ভৌগোলিক এলাকা জুড়ে রয়েছে।
রাজ্যে মোট পাঁচটি জাতীয় উদ্যান এবং দশটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। এখানে বেআইনিভাবে গাছ কাটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। এর ফলে দিন দিন বনভূমির পরিমাণ কমে আসছে। বিপন্ন হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য।
এ প্রসঙ্গে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানান, প্রতিদিনই চোরাই কাঠের কারবারীদের ধরার জন্য তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গরুমারা ন্যাশানাল পার্কের প্রবেশদ্বার লাটাগুড়ির সমস্ত কাঠচোরাই কল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।
ব্রিটিশ আমল থেকেই জঙ্গলের বহু পুরনো এবং ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছ কেটে টিম্বার টেন্ডার ডেকে সেগুলি বিক্রি করা হয়। যে জায়গায় গাছ কাটা হয়, সেখানে অন্তত কুড়িটি করে গাছের চারা লাগানো হয়। হিসেবটা হল, পাঁচটি চারা লাগানো হলে তিনটি বাঁচবে, দুটি মরবে। এই ভাবেই রাজ্যের পশ্চিমাংশে অধিকাংশ গাছ জমিদার, রাজা-মহারাজাদের লাগানো। এখানে এই গাছ কাটার কাজ করে ফরেস্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন।
এই টিম্বার টেন্ডারে দুর্নীতি ধরা পড়েছে। দেখা গেছে, টেন্ডার ডাকার পর তিনটি ঠিকাদারি সংস্থা দরপত্র জমা দিয়েছে এবং তিনটিরই মালিকানা একটি পরিবারের হাতে। আরও দেখা গেছে, একটি কোম্পানিই বারবার টেন্ডারের বরাত পেয়েছে। এই টেন্ডার দুর্নীতি ধরা পড়েছে প্রাক্তন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায়ের আমলে । সেই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন নতুন বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এর তদন্ত করছেন স্বয়ং মুখ্য বনপাল।
এই টেন্ডার দুর্নীতি রুখতে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক শুরু করেছেন ই-অকশন। ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে জঙ্গলের গাছ কাটার জন্য প্রতিদিন পাঁচ বার করে অকশন হচ্ছে। বনমন্ত্রী জানিয়েছেন, “এরপর থেকে এই অকশন হবে দিনে সাতবার করে। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ঘন্টায় ঘন্টায় অকশন হবে। অনলাইনে টেন্ডার জমা দিতে হবে। সেই টেন্ডার অনুমোদন পেলে একটি কোড দেওয়া হবে। সেটি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে দেখিয়ে টাকা জমা করতে হবে। টাকা আপনা আপনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে তহবিলে চলে আসছে। বনদফতর পাবে একটি রসিদ । সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে। সেই টিম্বার ভারতের যে কোনও জায়গায় পাঠানো যাবে। তার জন্য দেওয়া হবে ন্যাশানাল পারমিট।”